ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে থাকছে না সাত কলেজ

শিক্ষার মানোন্নয়নসহ নানা সমস্যা সমাধানে ২০১৭ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর সাত কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) অধিভুক্ত করা হয়। প্রায় আট বছর পর গতকাল সোমবার রাজধানীর সাত কলেজের অধিভুক্তি বাতিল করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু এই আট বছরে সমস্যা দূর না হয়ে বরং নতুন সংকটের সৃষ্টি হয়েছে। পাশাপাশি যুক্ত হয়েছে সাত কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের প্রতি অবহেলা। ফলে সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের আন্দোলন বড় আকার ধারণ করেছে।
ঢাবি সূত্র জানায়, অধিভুক্তি বাতিল হলেও সাত কলেজের বর্তমান শিক্ষার্থীদের শিক্ষা কার্যক্রম শেষ করতে দায়িত্বশীল থাকবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, যাতে তাদের শিক্ষাজীবন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। আগামী শিক্ষাবর্ষ (২০২৪-২৫) থেকে এই সাত কলেজ একটি স্বতন্ত্র কাঠামোর অধীনে যাবে। কিন্তু এতে ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষের ভর্তি কার্যক্রম নিয়ে বড় ধরনের জটিলতা তৈরি হয়েছে।

সাত কলেজের একাধিক শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত আট বছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত থাকায় লাভের চেয়ে ক্ষতিই বেশি হয়েছে। আর যেসব সমস্যার কারণে সাত কলেজকে ঢাবি অধিভুক্তি করা হয়েছিল, সেসব সমস্যা না মিটে আগের মতো রয়ে গেছে। মূলত গত আট বছরে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো পরীক্ষা গ্রহণের ভূমিকায় ছিল ঢাবি।

এতে সাত কলেজের কোনো উন্নয়ন না হলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফান্ড ভারী হয়েছে। কোনো পরিকল্পনা ছাড়া হঠাৎ অধিভুক্তি বাতিল হওয়ায় শিক্ষা কার্যক্রমে বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়বে সাত কলেজ। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সদস্য ও সাত কলেজের জন্য স্বতন্ত্র রূপরেখা প্রণয়ন কমিটির সদস্য অধ্যাপক মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খান বলেন, ‘সাত কলেজ নিয়ে যা হয়েছে, তা অমানবিক। আমি বলব, তাদের সঙ্গে অমানবিক আচরণ করা হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর দায় এড়াতে পারে না।

এখন ঢাবি উপাচার্যই বলতে পারেন, শিক্ষার্থীদের কী হবে? তবে সাত কলেজের জন্য স্বতন্ত্র রূপরেখা প্রণয়নে গত ২৯ ডিসেম্বর থেকে আমাদের চার মাসের সময় দেওয়া হয়েছে। আমরা চেষ্টা করব, এর আগেই যত দ্রুত সম্ভব আমাদের কাজ শেষ করা।’ সূত্র জানায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে আসার পর থেকে এই সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে আন্দোলন করছেন। সম্প্রতি তারা স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবিতে আন্দোলন করছেন। সাত কলেজে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে বিভাগভিত্তিক গুণগত মানের শিক্ষকের অভাব আছে। আবার শিক্ষার্থী অনুপাতে শিক্ষকসংকট বিরাজ করছে। কয়েক শ শিক্ষার্থীর বিপরীতে আট থেকে ৯ জন করে শিক্ষক। কিছু কলেজে বিভাগ অনুযায়ী তা আরো কম।

সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা বলছেন, তাঁরা একাডেমিক পড়াশোনার পর্যাপ্ত সুযোগ পাচ্ছেন না। শ্রেণিকক্ষের সংকটসহ অন্যান্য সংকট রয়েছে। বিজ্ঞান বিভাগের ল্যাবগুলোয় প্রয়োজনীয় উপকরণ নেই। ভালো মানের লাইব্রেরি কম। আবার কখনো কখনো সম্পূর্ণ পাঠ্যসূচি শেষ না করেই পরীক্ষা শেষ করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সেমিস্টার পদ্ধতি থাকলেও এই সাত কলেজে আবার বর্ষভিত্তিক ফলাফল প্রকাশ করা হয়। এ ছাড়া তাদের পরিচয় সংকট তো রয়েছেই।

ঢাকা কলেজ শিক্ষক পরিষদের সাবেক সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. কুদ্দুস সিকদার বলেন, ‘সাত কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্তি করাটা ছিল অপরিকল্পিত। এখন কোনো ধরনের রূপরেখা ছাড়া অধিভুক্তি বাতিল করাটা আরো বড় অপরিকল্পিত। গত আট বছরে সাত কলেজের শিক্ষার মানের উন্নয়নের চেয়ে পরীক্ষা গ্রহণেই বেশি ভূমিকা পালন করেছে ঢাবি। এমনকি শিক্ষকদের প্রশিক্ষণসহ শিক্ষার মান উন্নয়নে কোনো গুরুত্ব দেওয়া হয়নি।’

সরকারি তিতুমীর কলেজ শিক্ষক পরিষদের সম্পাদক অধ্যাপক এস এম কামাল উদ্দিন হায়দার বলেন, ‘এ মুহূর্তে আমাদের চারটি বর্ষের পরীক্ষা চলমান। এখন নতুন শিক্ষাবর্ষের ভর্তি কার্যক্রম শুরু করার কথা। যদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষের ভর্তি কার্যক্রম পরিচালনা না করে, তাহলে নতুন রূপরেখার অধীনে আসতে সময় লাগবে। এতে শিক্ষার্থীরা বড় ধরনের সেশনজটে পড়বে।’

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্তির চেয়ে কিছু বিষয়ে সামান্য উন্নতি হয়েছে। আগে যেখানে যেনতেন ক্লাস করলেও পরীক্ষা দেওয়া যেত, সেখানে এখন পরীক্ষার জন্য নির্ধারিতসংখ্যক ক্লাসের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। যদিও এ ক্ষেত্রে কলেজগুলো ছাড় দেয়। আবার জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে জিপিএর ভিত্তিতে ভর্তি করা হলেও এখন কলেজগুলোতে ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়। ফলে তুলনামূলকভাবে মেধাবীরা ভর্তি হতে পারছেন। শিক্ষার্থী সংখ্যাও কিছুটা কমিয়ে আনা হচ্ছে।

কলেজগুলো হচ্ছে ঢাকা কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজ, সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ, কবি নজরুল সরকারি কলেজ, বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ, সরকারি বাঙলা কলেজ ও সরকারি তিতুমীর কলেজ। এসব কলেজে শিক্ষার্থী প্রায় দেড় লাখ। শিক্ষক এক হাজারের বেশি।

সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন সময়ে তাঁদের আন্দোলনে ৯ দফা দাবি জানান। সেগুলো হলো অধিভুক্তি বাতিল নয়, সমস্যাগুলোর স্থায়ী সমাধান করা; সাত কলেজের সমস্যা সমাধানে একটি স্থায়ী পদ্ধতি অনুসরণ; সাত কলেজের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য আলাদা একটি একাডেমিক ভবন তৈরি; প্রশ্নপত্র প্রণয়ন, উত্তরপত্র যাচাই ও রেজাল্ট প্রকাশ সাত কলেজের শিক্ষক দ্বারা পরিচালিত করা; পরীক্ষার ৯০ দিনের মধ্যেই রেজাল্ট প্রকাশ; প্রতিটি সেশনে এক বছরের বেশি কালক্ষেপণ না করা; শিক্ষকদের প্রতিটি ক্লাস গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া; নিভর্ভুলভাবে প্রতিটি সেশনের রেজাল্ট প্রকাশ করা এবং সাত কলেজের জন্য পর্যাপ্ত শ্রেণিকক্ষ, পরিবহন ও আবাসনের ব্যবস্থা করা। এগুলোর ব্যাপারে তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি।

ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ ও সাত কলেজের সমন্বয়ক অধ্যাপক এ কে এম ইলিয়াস বলেন, ‘চলতি শিক্ষাবর্ষ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাত কলেজে নতুন কোনো শিক্ষার্থী ভর্তি নেবে না। ইউজিসি চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে সাত কলেজের জন্য যে বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠিত হয়েছে, তারা শিগগিরই একটা রূপরেখা দেবেন। সে অনুযায়ী সাত কলেজ নিয়ে একটা বডি হবে। নতুন এ বডির অধীনে ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষের ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। এভাবে সাত কলেজের অধিভুক্ত বাতিল প্রক্রিয়া শুরু হবে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে সাত কলেজের যে চলমান সেশনগুলো রয়েছে, তাদের বিষয়ে জানতে চাইলে অধ্যাপক এ কে এম ইলিয়াস বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে নতুন করে শিক্ষার্থী ভর্তি না করা হলেও বর্তমান শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন ঢাবির অধীনে শেষ করতে তাঁরা সম্মত। আমি বিষয়গুলো নিয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলব। তাঁদের সিদ্ধান্তই প্রাধান্য দেওয়া হবে।’

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *