বাঙালি মন! বাঙালি চরিত! ২

শিব্বীর আহমেদঃ বাঙালিদের ‘টেনে’ নামানোর গল্প অতি পুরাতন। সতের ফুট গভীরতার জলহীন এক কুয়ায় পড়েছে চার বাঙালি। একজন হিসেব করে দেখল, একজনের ঘাড়ে একজন এমন করে তিনজন দাঁড়ালেই তারা কুয়ো থেকে উঠে আসতে পারে। পরে দেখা গেল, তিনজন দাঁড়ানোর চেষ্টা করলে চতুর্থ জন তাদের টেনে নিচে নামিয়ে ফেলে। এই টেনে নামানোই চলতেই থাকে। কুয়ার উপরে ওঠা আর হয় না বাঙালির। হাজার বছর ধরেই এমনই চলছে? একদিন মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন দোযগ দেখতে বের হলেন। দোযগ দেখতে এসে তাঁর সৃষ্টির কষ্ট দেখে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন আগামীকাল সকাল ছয়টা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত দোযগের দরোজা খুলে দিবেন। দরোজা দিয়ে যারা বের হয়ে আসবে তারাই কোন হিসাব-নিকাশ ছাড়াই বেহেশত চলে যেতে পারবেন। পরেরদিন যথারিতি দোযগের দরোজা খুলে দেয়া হল। সারাদিন বিভিন্ন দরোজা দিয়ে মানুষ বের হয়ে বেহেশতে চলে যেতে শুরু করল। বিকেল বেলা মহান রাব্বুল আলামীন আবারো দেখতে এলেন দরোজা দিয়ে কোন কোন সম্প্রদায়ের মানুষ বের হয়ে বেহেশতে চলে যাচ্ছে। তিনি লক্ষ্য করলেন, দোযগের প্রতিটি দরোজা দিয়ে মানুষ স্রোতের মত বের হয়ে বেহেশতে চলে যাচ্ছে।

কিন্তু হঠাৎ করেই দোযগের একটি দরোজার দিকে লক্ষ্য করে দেখলেন ঐ দরোজা দিয়ে কেউ বের হচ্ছেনা। কিছুটা অবাক হয়ে তিনি দোযগের ফেরেশতাদেরকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এই দরোজা দিয়ে কেউ বের হচ্ছেনা কেনো? এখানে কোন সম্প্রদায়ের মানুষ আছে?’ দোযগের ফেরেশতারা উত্তর দিয়ে বললেন, ‘হে রাব্বুল আলামীন, এখানে বাংলাদেশের বাঙালিরা আছে। এরা হিংসুক জাতি। এরা অন্যের ভালো দেখতে পারেনা। একজন ভালো কিছু করলেই দশজন মিলে বদনাম শুরু করে দেয়। একজন বের হতে চাইলে দশজন টেনে নিচে নামিয়ে ফেলে দেয়।’ ফেরেশতাদের কথা শুনে দরোজা দিয়ে দোযগের ভিতরে তাকালেন। দেখলেন, যখনই কোন বাঙালি দরোজা দিয়ে বের হতে যায় তখনই দশ বারোজন তাকে টেনে নিচে ফেলে দেয়। ফলে সারাদিন দোযগ থেকে কোন বাঙালি বের হয়ে বেহেশতে যেতে পারলনা।

ভারতে মোগল বংশের প্রতিষ্ঠাতা মির্জা জহির-উদ-দীন মুহাম্মদ বাবর তার আত্মজীবনীমূলক বই ‘বাবরনামা’য় লিখেছেন ‘বাংলায় অদ্ভুত রীতি আছে। এখানে জনগণ সিংহাসনকে শ্রদ্ধা করে। রাজাকে হত্যা করে যেকোনও ব্যক্তি সিংহাসনে বসুক না কেন, তাকে সকলে রাজা বলে স্বীকার করে।’ স¤্রাট বাবরের ওই উক্তি যে মিথ্যা নয়, তা ঐতিহাসিকভাবে বহুবার প্রমাণিত হয়েছে। ইংরেজ বাহিনীর সঙ্গে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার পলাশীর যুদ্ধে ইংরেজ বনাম নবাব বাহিনীর যুদ্ধে জনতা নীরব দর্শক হিসেবে ইংরেজদের সিংহাসন দখলকে উপভোগ করেছে। বাংলার জনসাধারণের ওই মানসিকতার পরিচয় আমরা ইংরেজ সেনাপতি রবার্ট ক্লাইভের বক্তব্য থেকেও পেয়েছি। রবার্ট ক্লাইভ লিখেছেন: ‘২৯ জুন, তিনি ২০০ ইউরোপীয় ও ৫০০ দেশীয় সৈন্য নিয়ে বিজয়গর্বে মুর্শিদাবাদে প্রবেশ করেন। এই উপলক্ষে লাখো দর্শক উপস্থিত হয়। তারা ইচ্ছা করলে শুধু লাঠি ও ঢিলা দিয়েই ইউরোপীয় সৈন্যদের মেরে ফেলতে পারতো। কিন্তু বাঙালিরা তা করেনি।’ বরং বাঙালি বিদেশিদের দেখে মজা পেয়েছে। বাসায় গিয়ে খোশগল্প করেছে, ইংরেজরা দেখতে কেমন ছিল, তা নিয়ে। আর এভাবেই হাসতে হাসতেই বাঙালিরা ইংরেজদের আড়াই শত বছর গোলামি মেনে নিয়েছিল। বাঙালির এই স্বভাব আজও বদলায়নি। রাস্তা দিয়ে কোনও বিদেশি গেলে হা করে তাকিয়ে থাকে। বাসায় গিয়ে বা বন্ধুদের আড্ডায় বুক ফুলিয়ে গল্প করে!

পলাশীর দুর্দশা কাটিয়ে স্বাধীনচেতা মীর কাসিম ইংরেজদের বিরুদ্ধে আজাদির ঝান্ডা উড়িয়েছিলেন। নবাব সিরাজের মতো মীর কাসিমও বাঙালির সমর্থন পাননি। বক্সারের যুদ্ধ বাংলাকে গোলামির স্থায়ী শেকল পরিয়েছে। ইতিহাসবিদরা কি বলতে পারবেন, সেই যুদ্ধে বাঙালির ভূমিকা কী ছিল? সাধারণ বাঙালির পলাশী বক্সার নিয়ে মাথাব্যথা ছিল? আর ওই মাথাব্যথা না থাকাই ইংরেজদের বাংলায় ঔপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠাকে সহজ করে দিয়েছিল। যদি সে দিন বাঙালি মীর কাসিমের পাশে দাঁড়িয়ে ইংরেজদের বিরুদ্ধে যার যা কিছু আছে তা নিয়ে লড়তো, তাহলে বাংলার ইতিহাস ভিন্ন হতো।

বংশপরম্পরায় বাঙালির ভাবলেশহীন মানসিকতা তার জন্য সর্বনাশের কারণ হয়েছে। ১৭৫৭ সালে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ-উদ-দৌলাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হলেও বিশ্বাসঘাতক মীর জাফরের বিরুদ্ধে তারা রুখে দাঁড়ায়নি। ইংরেজদের বিরুদ্ধে মীর কাসিমের যুদ্ধে তার হয়ে বক্সারে লড়েনি। বরং তারা ইংরেজদের নিয়মিত কর দিয়েছে। বাঙালির সেই করের টাকা দিয়ে ইংরেজরা তাদের সামরিক বাহিনীকে শক্তিশালী করে তাদের শাসন ভারতজুড়ে বিস্তৃত করেছে।

বাংলার জন্য অন্তর যেমন পোড়ে তেমনি বাংলা নিয়ে নাক সিটকানো বাঙালিরও অভাব নেই। বিদেশি মদের দাম যখন খুব বেড়ে যায় তখন শ্রেণি সচেতনতা ভুলে কেউ কেউ কেরু কোম্পানির মদ খায়। কাব্য করে তখন বাঙালি বলে এটা কিন্তু ‘এক্সপোর্ট’ কোয়ালিটি যদিও ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’! এর চেয়েও নিচে নামতে হলে বাঙালি বলে, ‘বাংলা’ আছে খাবেন? ¯্রফে বাংলাতে নামলে কী অপমানবোধ হয়? ভিসিআর যুগে ভিডিও ক্যাসেটের দোকানে লেখা থাকতো, ‘এখানে বাংলা ছবির ক্যাসেট ভাড়া দেয়া হয় না’। আবার সিগারেট যদি ফাইভ ফিফটি ফাইভও হয় তাহলে সেটা ভাগ করা হতো দুইভাগে। একটাকে বলা হতো ‘লন্ডন ফাইভ’ আরেকটাকে অবজ্ঞা করে বলা হতো ‘বাংলা ফাইভ’। দামে সস্তা বলে কেউ কেউ বাংলা ফাইভ ফুঁকলে ট্যাগ লাইন জুড়ে দিতেন এভাবে যে, ‘একটু কড়া, তাই খাই’। বাংলা মদ থাকলেও বাংলা নামের কোনো গাঁজা নেই।

শাশ্বত বাংলার মানুষ সাধারণ বেচা-বিক্রিতেও প্রতারণা করে। ধরুন, আপনি সাড়ে ছয়ফুট লম্বা মানুষ। গেছেন ছোট মাছ কিনতে। হাত দিয়ে মাছটা ধরে, চোখ দিয়ে দেখে বললেন, ‘ওই মাছওয়ালা, আপনার মাছ তো আধা পচা’। মাছওয়ালা মাথা সোজা করে আপনাকে দেখবে। তারপর বলবে, ‘কী বলার লাগছেন? মাছ তো দেখতাছেন দোতালা থিক্কা। মাছ চিনতে হইলে জলে নামতে হয়’!

বাঙালি নাকি ঠিক কাজটা সময় মতো করে না, যখন যেটা করার দরকার সময় এলে সেটা নাকি ঠিকই ভুলে যায়। বাঙালি যা বিশ্বাস করে সেটা নাকি বলে না। আর যা বিশ্বাস করে তা নাকি পালন করে না। আর প্রথাবিরোধী লেখক হুমায়ুন আজাদ বলতেন, ‘বাঙালি নারীর চরিত্র চিত্রণ হয় এটা মেপে যে সে পরপুরুষে আসক্ত কি না! আর পুরুষের চরিত্র বিচার হয় সে মদ্যপান করে কিনা কিংবা পরনারীতে আসক্ত কি না!’

বাঙালি নাকি স্বভাবগত ভাবেই ফাঁকিবাজ। নিজের দেশে বসে সে পায়ের ওপর পা তুলে খেতে চায়। অন্যকে শাসন করতে চায় আর চাপাবাজি করে নিজের বংশ পরিচয় অন্যদের চেয়ে বড় জাহির করে রাজা উজির মারতে চায়। কোনো কাজ ভালমতো না শিখে সে যখন জমি বেচে বিদেশ যায় তখন তাকে বিদেশে গিয়ে বাজে কাজটাই হয়তো (ইংরেজিতে বলে-অড জব) করতে হয়। একারণে বিদেশেও বাঙালিদের নিয়ে অনেক গল্প আছে যেগুলো খুব একটা সুখকর নয়। যেমন এক লোক প্রতিবছর এক মাস বাড়তি ছুটি চায় এবং জানতে চাইলে অফিসের বসকে বলে, ‘তার বউয়ের বাচ্চা হবে।’ বিদেশি বস তিন তিনবার সহ্য করার পর চতুর্থ বছরে যখন ওই বাঙালি আবারো ছুটি নিতে চাইল তখন বস জিজ্ঞাসা করল, ‘রোদ বাড়লে বা বৃষ্টি নামলে কী করো?’ লোকটি উত্তর দেয়, ‘স্যার ছাতা ব্যবহার করি।’ বস এবার ক্ষেপে গিয়ে বললো, ‘বউয়ের সামনে যেয়ে যখন আবেগায়িত হয়ে যাও তখন ছাতার মতো কিছু একটা ব্যবহার করতে মনে থাকে না? এরপর থেকে এটা মনে না রাখলে চাকরি থাকবে না।’
বাঙালির ধ্যানজ্ঞান থাকে চাকরি পাওয়া নিয়ে। চতুর্থ শ্রেণির সরকারি চাকরির জন্য পাঁচ-দশলাখ টাকাও খরচ করে ফেলে। জমি বিক্রি করে বিদেশে গিয়ে হয়তো ‘অড’ জব করে। বিদেশ যেতে না পারলে আফ্রিকার কোনো দেশ থেকে হয়তো এক নৌকায় তিনশ জন রওনা করে এবং সমুদ্র পাড়ি দিতে গিয়ে মারাও পড়ে। বাংলার চেয়ে অন্যান্য দেশের হাতছানি বাঙালির কাছে মধুরতম। হয়তো বাঙালি ‘অন্যদেশ কাতর’-এর মতো বেশিমাত্রায় ‘পরশ্রীকাতর’!

‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান লিখেছেন, ‘পরশ্রীকাতরতা ও বিশ্বাসঘাতকতা আমাদের রক্তের মধ্যে রয়েছে। বোধ হয় দুনিয়ার কোনো ভাষাতেই এই কথাটা পাওয়া যাবে না, পরশ্রীকাতরতা।’ বাঙালির পরশ্রীকাতরতা নিয়েও অনেক গল্প আছে। যেমন, দুই প্রতিবেশির গল্প। এক প্রতিবেশি অন্য প্রতিবেশিকে হিংসা করে, দৌড়ের ওপর রাখে। একজন অন্যজনের উঠোন নষ্ট করে তো অন্যজন ক্ষেতের ধান কেটে নেয়। এই পরিস্থিতিতে একজন দরবেশ এলো সেখানে। দুই প্রতিবেশিকে ডেকে বলল, ‘তোমরা আমার কাছে ভাল কিছু চাও। অন্যের জন্য যা চাইবে নিজের বেলায় তার দ্বিগুণ পাবে।’ এক প্রতিবেশি জানত অন্য প্রতিবেশির একটা কিডনি নষ্ট। সে কোনো কিছু না ভেবেই দরবেশকে বলল, ‘ওনার ভাল কিডনিটা নষ্ট করে দেন!’ তার প্রতিবেশি মারা গেলেও দুটো কিডনি হারিয়ে মারা গেল সে নিজেও! বাঙালি হয়তো এখনও জানে না পরশ্রীকাতরতার কারণে তাদের দ্বিগুণ ক্ষতি হচ্ছে। কথায় বলে, বাঙালির গরু মেরে জুতা দান বা নিজের পা কেটে অন্যের যাত্রা ভঙ্গ করা বাঙালির এক স্বভাবজাত অভ্যেস।

প্রকৃতিগত কারণে বাঙালি নাকি দারুণ অলস। নিজে গাছ না লাগালেও পাখির মাধ্যমে গাছ হয় এখানে। ফসল লাগালে ফসল হয়। আর কিছু না থাকলে আগে মাছ ধরে মাছ বেচে খেত বাঙালি। যার জন্য অনেকেই বলত, ‘লেখাপড়া করিয়া কেন মরিব দুঃখে? মৎস ধরিব খাইব সুখে’! অলসতা নাকি শয়তানি, সমালোচনা, হীনমন্যতা আর পরশ্রীকাতরতা বাড়ায়। (চলবে)

– কথাসাহিত্যিক ঔপন্যাসিক।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *