শিল্পপ্রতিষ্ঠান বিপদে, থমকে আছে অর্থনৈতিক উন্নতি

কোনোভাবেই ডলার-সংকট পেছনে ফেলে আসা যাচ্ছে না। বরং সময়ের সঙ্গে তা এক গভীর ছায়ার মতো দেশের অর্থনীতিকে আঁকড়ে ধরেছে। এই কঠিন পরিস্থিতিতে রেমিট্যান্সের ধারা আগের বেগে চলতে পারছে না, আর রিজার্ভও ধীরে ধীরে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। এর প্রভাব এখন স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে ব্যাংকগুলোয়। আবার ডলারের সরবরাহে দেখা দিয়েছে সংকট। ডলারের অভাবে ব্যাংকগুলোয় অনেকের এলসি খোলা সম্ভব হচ্ছে না। বিশেষ করে ১১টি ব্যাংক ডলার-সংকটে হিমশিম খাচ্ছে। এর ফলে এসব ব্যাংকের সঙ্গে লেনদেনকারী শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর উৎপাদন থেমে যাওয়ার মতো আশঙ্কা তৈরি হয়েছে, যেন তাদের সামনে অপেক্ষা করছে এক বন্ধ দরজা, যার চাবি নেই হাতে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি বছরের ডিসেম্বরে ডলারের সরবরাহে বড় ঘাটতি দেখা গেছে, যা গত ৫ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম। ডিসেম্বর শেষে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছে মোট ডলার ছিল ৪ হাজার ২৫৫ মিলিয়ন, যা নভেম্বরে ছিল ৪ হাজার ৩৮৩ মিলিয়ন। অর্থাৎ এক মাসে ১২৮ মিলিয়ন ডলার সরবরাহ কমেছে। এর আগে ২০১৯ সালের নভেম্বরে ডলারের সর্বনিম্ন পরিমাণ ছিল ৪ হাজার ১৯১ মিলিয়ন। বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা জানান, ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক এবং আইএফআইসি ব্যাংকের গ্রাহকেরা এলসি খুলতে বিভিন্ন সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন।

ব্যাংকগুলো সাধারণত বিলাসী পণ্য ও প্রস্তুত পণ্য আমদানির জন্য ডলার দিতে বেশি আগ্রহী; কারণ, সেগুলো থেকে বেশি কমিশন পাওয়া যায়। কিন্তু কাঁচামাল, নিত্যপণ্য এবং ফলমূলের এলসি খুলতে কম কমিশন আসে, তাই এসব পণ্যের জন্য প্রয়োজনীয় ডলার পাওয়া যাচ্ছে না। যদি ডলারের রিজার্ভ না বাড়ে, তাহলে উৎপাদনে বড় সমস্যা হতে পারে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। গত জুলাই মাসে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছে মোট ডলার ছিল ৬ হাজার ৮৮ মিলিয়ন, আগস্টে ৫ হাজার ২৬৫ মিলিয়ন, সেপ্টেম্বরে ৪ হাজার ৯৮১ মিলিয়ন এবং অক্টোবরে ৪ হাজার ৬১৫ মিলিয়ন ডলার।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (ডিসিসিআই) সাবেক সভাপতি আশরাফ আহমেদ বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক নানা উদ্যোগ নিলেও ডলার-সংকট কাটেনি, বরং আরও বাড়ছে। ব্যক্তিপর্যায়ে ডলার কিনতে সমস্যা হচ্ছে এবং কৃত্রিমভাবে ডলারের দাম নির্ধারণে বাজারে বেশি দামে পাওয়া যাচ্ছে। অনেকেই ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে অর্থ নিয়ে আসছেন। তাই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উদ্যোগে কিছু সংস্কার প্রয়োজন এবং রপ্তানি ও রেমিট্যান্স বাড়ানোর দিকে মনোযোগ দিতে হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভও ওঠানামা করছে, বর্তমানে মোট রিজার্ভ ২ হাজার ৫২২ কোটি ডলার বা ২৫ দশমিক ২২ বিলিয়ন ডলার। তবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাব, বিপিএম-৬ অনুযায়ী রিজার্ভ ১ হাজার ৯৯৩ কোটি ডলার। ১৫ জানুয়ারি এই পরিমাণ ছিল ২ হাজার ১৩ কোটি ডলার।

বেসরকারি একটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জানান, আমদানি কমিয়ে ডলারের বাজার নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর হয়েছে। এর ফলে জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমছে, সরকার রাজস্ব হারাচ্ছে এবং ব্যাংকগুলোর আয়ও কমছে। অনেক বড় কোম্পানি তাদের বিনিয়োগের অর্থ ফেরত পাচ্ছে না, নতুন শিল্প গড়ে উঠছে কম এবং কাঁচামাল না পেয়ে অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম ২৫ দিনে দেশে ১৬৭ কোটি ৫৯ লাখ ডলার রেমিট্যান্স এসেছে, যা দেশের মুদ্রায় ২০ হাজার ৪৪৫ কোটি ৯৮ লাখ টাকা। গত ডিসেম্বরের একই সময়ে রেমিট্যান্স ছিল ২১৬ কোটি ডলার, অর্থাৎ জানুয়ারিতে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমেছে।

জানতে চাইলে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এবং সিইও সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ডলার-সংকট চলছেই। বাজার স্থিতিশীল করতে দরকার আন্তব্যাংক লেনদেন কার্যকর করা। কিন্তু সেটি হচ্ছে না; কারণ, ব্যাংকগুলোর কাছে যথেষ্ট ডলার নেই। শুধু প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যাংকগুলো রেমিট্যান্স কিনছে।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *