‘তৌহিদী জনতা’ কারা?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীকে ‘পর্দা না করা’ নিয়ে হেনস্তার ঘটনায় মোস্তফা আসিফ অর্ণব নামের এক ব্যক্তিকে আটক করে রাজধানীর শাহবাগ থানায় নেওয়া হয়। তবে অভিযুক্তকে ছাড়িয়ে আনতে বুধবার (৫ মার্চ) মধ্যরাতে স্বঘোষিত ‘তৌহিদী জনতা’ থানার সামনে ও ভেতরে অবস্থান নেয়। পরদিন বৃহস্পতিবার ঢাকার প্রধান মহানগর হাকিম (সিএমএম) আদালত থেকে তাঁকে জামিন দেওয়া হয়। এ সময়ও অর্ণবের সঙ্গে ছিল ‘তৌহিদী জনতা’। শাহবাগ থানা ও আদালতে অবস্থান নেওয়া এই ‘তৌহিদী জনতা’ কারা? তা যাচাই-বাছাই করেছেন ফরাসি বার্তা সংস্থা এএফপির ফ্যাক্ট চেক বিভাগের বাংলাদেশ সম্পাদক কদরুদ্দিন শিশির। এ নিয়ে তিনি নিজের ফেসবুক ওয়ালে একটি পোস্ট দিয়েছেন।

ওই পোস্টে কদরুদ্দিন লিখেছেন, হেনস্তাকারীকে বের করে এনে গলায় ফুল, হাতে পবিত্র কোরআন আর মাথায় পাগড়ি পরিয়ে মিছিল দেওয়া হয়েছে। এ ঘটনাকে আরও অনেক ঘটনার মতো ‘তৌহিদী জনতার’ কাণ্ড বলে প্রচার করা হচ্ছে। এখানে ‘তৌহিদী জনতা’ বলতে ‘ধার্মিক আমপাবলিক’ বলেই বোঝানো হচ্ছে। কিন্তু এ ঘটনার সঙ্গে সাম্প্রতিক অতীতে আরও কয়েকটি ঘটনার ছবি বিশ্লেষণ করে মনে হচ্ছে, শাহবাগের এ ঘটনা (এবং এরকম ‘তৌহিদী জনতার’ কাণ্ড বলে চালানো) আরও অনেক ঘটনা র‍্যানডম ‘ধার্মিক আমপাবলিক’-এর তাৎক্ষণিক ক্ষোভ থেকে উৎসারিত স্বতঃস্ফূর্ত ঘটনা নয়, বরং এগুলো কো-অর্ডিনেটেড ঘটনা।

আমি সাম্প্রতিক তিনটি ঘটনার কিছু ছবি/ফুটেজ বিশ্লেষণ করেছি। ঘটনা তিনটি হলো, গত নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে প্রথম আলো পত্রিকার সামনে দুই দিনব্যাপী বিক্ষোভ এবং গরু জবাই কর্মসূচি, ডেইলি স্টার পত্রিকার ভবনের গেট বন্ধ করে বিক্ষোভ ও জুমার নামাজ আদায় কর্মসূচি এবং গতকাল রাতে শাহবাগ থানায় আটক নারী হয়রানিকারী যুবককে ছাড়িয়ে নেওয়ার ঘটনা।

এই তিন ঘটনায় কয়েক শ লোককে জড়ো করে সামনের সারিতে থেকে তাদের নেতৃত্ব দেওয়া অন্তত তিনজন সব জায়গায় কমন। তাঁদের মধ্যে দুজনের নাম ও পরিচয় জানা গেছে। একজন আবু সাঈদ শের মোহাম্মদ খান, যাঁর ফেসবুক প্রোফাইল Sher Muhammad। শের মোহাম্মদকে ২০২২ সালের নভেম্বর মাসে জামাআতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বিয়ার অর্থ সরবরাহকারী সদস্য হিসেবে আটক করে র‍্যাব। অনলাইন শরিয়াহ গ্র্যাজুয়েশন ইনস্টিটিউট নামে একটি প্রতিষ্ঠানের পরিচালক তিনি। ৫ আগস্টের পর আল-কায়েদার কালো পতাকার সমর্থনে প্রচারণা চালাতে দেখা যায় তাঁকে। ২০১৫ সালে হাটহাজারিতে তাঁর বিরুদ্ধে সন্ত্রাস দমন আইনে একটি মামলা হয়।

প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারের সামনে বিক্ষোভে তাঁকে নেতৃত্ব দিতে একাধিক ভিডিওতে দেখা গেছে। শাহবাগের গত রাতের ঘটনায় তাকে ‘আমির‘ হিসেবে ঘোষণা করে একটি ভিডিও বক্তব্য দিয়েছেন আতাউর রহমান বিক্রমপুরী, (যাঁর পরিচয় নিচে দেওয়া হল)। দ্বিতীয় ব্যক্তি হলেন আতাউর রহমান বিক্রমপুরী। তিনি প্রথম আলোর সামনের বিক্ষোভে এবং সেখান থেকে আটক করে থানায় নিয়ে যাওয়া কয়েকজনকে থানা থেকে জোরপূর্বক ছাড়িয়ে নেওয়ায় তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং শাহবাগ থেকে নারী হয়রানিকারী ছাড়িয়ে নিতেও তিনি যশোর থেকে ঢাকায় এসে নেতৃত্ব দিয়েছেন।

বিক্রমপুরী তাঁর ওয়াজ, অনলাইন বয়ান ও ফেসবুকে অতি উগ্র কথাবার্তা প্রচারের জন্য পরিচিত। সম্প্রতি তিনি তাঁর এক ফেসবুক পোস্টে বায়তুল মোকাররমের বর্তমান খতিব মাওলানা আব্দুল মালেককে মুনাফেক ও ‘তাগুতের কুকুর’ বলে অভিহিত করেন। এ ছাড়া তিনি ‘অ্যান্টি শাতিম মুভমেন্ট’ নামে একটি ফেসবুক পেজ চালান, যেখানে গত ২২ ফেব্রুয়ারি এক পোস্টে ’শাতিমে রসুল’ হিসেবে কাউকে চিহ্নিত করা গেলে তাকে হত্যার আহ্বান জানানো হয়। গণতন্ত্র চর্চাকারী মুসলিমদের ‘কাফির’ মনে করে তিনি নিয়মিত পোস্ট করেন এবং বয়ান করেন। নাস্তিকদের হত্যা করার জন্যও তিনি উসকানি দেন। আইএসকে খারেজি মনে করলেও আল-কায়দা ও তালেবানকে হকপন্থী দল বলে প্রচারণা চালান।

২০২১ সালে তাঁকে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্য হিসেবে গ্রেপ্তার করা হয়। আতাউর কারাগারে থাকা জঙ্গিদের মুক্তির জন্য কাজ করা বৈষম্যহীন কারামুক্তি আন্দোলনের একজন কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক। এবং ৫ আগস্টের পর তিনি তাঁর দলবল নিয়ে কাশিমপুর কারাগার থেকে জঙ্গিদের মুক্ত করে আনার জন্য জড়ো হয়ে কর্মকর্তাদের জেরা করেন। তৃতীয় আরেকজনকে ওপরের তিনটি ঘটনায়ই শের মোহাম্মদের পাশে থেকে নেতৃত্ব দিতে দেখা গেছে, কিন্তু তার পরিচয় জানা যায়নি।

অর্থাৎ, ‘তৌহিদী জনতা‘র স্বতঃস্ফূর্ত কাণ্ড বলে প্রচার চালানো হলেও দেখা যাচ্ছে এই ঘটনাগুলোতে মানুষ জড়ো করার পেছনে উগ্রপন্থী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সক্রিয় ব্যক্তিদের কো-অর্ডিনেশনের বিষয়টি স্পষ্ট। ‘তৌহিদী জনতার’ অপর এক যুবক আরমান উদ্দিন সম্পর্কে শিশির লিখেছেন, গতকাল থেকে শাহবাগের ঘটনায় এই ছেলের বেশ কিছু ভিডিও দেখেছিলাম। সে ঘটনাস্থল থেকে নানান আপডেট দিচ্ছিল নারী হয়রানিকারী ছেলেটিকে ছাড়িয়ে আনার বিষয়ে। মানে, শাহবাগের মবে সে অন্যতম সক্রিয় একজন ছিল।

কিন্তু আজ (বৃহস্পতিবার) বিকেল থেকে আইডিটি লক করেছে তার পুরোনো কয়েকটি পোস্টের স্ক্রিনশট ভাইরাল হওয়ার পর। ওই সব পোস্টে দেখা যাচ্ছে ছাত্রলীগের তার এলাকার নেতাদের নানান সময়ে অভিনন্দন জানাতে। আমার আগের পোস্টটির পর কয়েকজন আমাকে বইমেলায় গত ১০ ফেব্রুয়ারি সব্যসাচী প্রকাশনীর স্টলে হামলায়ও শাহবাগ থানার (ও প্রথম আলো ডেইলি স্টারে জমায়েত করা) গ্রুপটির জড়িত থাকার সম্ভাবনার কথা জানিয়েছে।আমি বইমেলায় হামলার সময়ের ও পরবর্তী কয়েকটি ভিডিও দেখে নিশ্চিত হয়েছি ‘আরমান উদ্দিন’ নামের এই ছেলে সব্যসাচীর স্টলে জড়ো হওয়া গ্রুপটির নেতৃত্বে ছিল। তবে বিক্রমপুরী/শের মোহাম্মদকে বইমেলার কোনো ভিডিওতে দেখা যায়নি বা তাদের গ্রুপের সঙ্গে আরমান উদ্দিন বা ওই দিনের ঘটনায় নেতৃত্ব দেওয়া অন্যদের সংযোগ থাকার তেমন কোনো ভিজুয়াল অ্যাভিডেন্স এখনো পর্যন্ত পাইনি।

তবে বিষয়টি ইন্টারেস্টিং যে, বইমেলায় মব হামলার ঘটনায় নেতৃত্ব দেওয়া আরমান উদ্দিন শাহবাগের মবেও সক্রিয় ছিলেন। কদরুদ্দিন শিশির আরও লেখেন, তৃতীয় যে ব্যক্তিটির পরিচয় তখন পাইনি, তিনি হচ্ছেন মোহাম্মদ তামিম (তাঁর ফেসবুক আইডি মতে)। তিনি সরকারি ইউনানি ও আয়ুর্বেদিক মেডিকেল কলেজের ছাত্র বলে অনলাইনে পাওয়া ওই কলেজের একটি ভিডিও থেকে নিশ্চিত হওয়া গেছে। এ ছাড়া তাঁর বাসা মিরপুর ১০ এলাকায় বলে জানিয়েছেন ওই এলাকার এক বাসিন্দা, যিনি তামিমকে ব্যক্তিগতভাবে চেনেন।

ওই বাসিন্দা আরও জানান, তামিম কয়েক বছর আগের উগ্রপন্থী কার্যকলাপের জন্য গ্রেপ্তার হয়েছিলেন এবং পরে জামিনে বের হন। তামিমের ফেসবুক আইডিতে ৫ আগস্টের পর এক পোস্টেও তার ২০১৫ সালে কারাগারে থাকার স্মৃতির কথা উল্লেখ করেছেন। তবে তাঁর গ্রেপ্তার হওয়ার পেছনের কারণ কী ছিল তা উল্লেখ নেই। আমিও অনলাইনে কোনো ক্রেডিবল সূত্র থেকে তাঁর গ্রেপ্তারের পেছনের কারণটি পাইনি। পেলে পোস্টে আপডেট করে দেব। সূত্রঃ আজকের কাগজ

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *