শিব্বীর আহমেদঃ শব্দদূষণ এক ধরনের মারাত্মক পরিবেশ দূষণ। দিন দিন এ দূষণের মাত্রা বেড়েই চলেছে। অনেক পরিবেশবাদী বাংলাদেশের শব্দদূষণকে ‘শব্দসন্ত্রাস’ নামে অভিহিত করেছেন। বর্তমানে সারাদেশে শব্দদূখু যে পর্যায়ে অবস্থান করছে তা খুবই আশঙ্কাজনক। বাড়িতে, অফিসে, রাস্তাঘাটে সবাইকে কমবেশি শব্দদূষণের শিকার হতে হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী মানুষ পরিবেশ দূষণ রোধে সোচ্চার। বর্তমান সময়ে বায়ুদূষণ-পানি দূষণ রোধ এবং বনায়নের বিষয়গুলো আলোচিত হলেও শব্দদূষণ সম্পর্কে আলোচনার গন্ডি একেবারেই সীমিত। শব্দদূষণের কারণেও মারাত্মক রকমের স্বাস্থ্য সমস্যা তৈরি হচ্ছে, যা নিয়ে জনসাধারণের মাঝে সুস্পষ্ট ধারণা নেই। বেশ কয়েকটি বেসরকারি সংগঠন এ নিয়ে কাজ করলেও তা সমস্যার তুলনায় খুবই সামান্য।
শব্দদূষণকে বলা হয় ‘নীরব ঘাতক’। বিভিন্ন শহরে শব্দদূষণের বহু উৎস রয়েছে, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি। গাড়ির হর্ন, নির্মাণকাজ, মাইকের ব্যবহার, শিল্প-কারখানা কোনো ক্ষেত্রেই শব্দদূষণ বিষয়ে যেসব নিয়ম রয়েছে তা মানা হচ্ছে না। ভোর হতে মধ্যরাত পর্যন্ত হকার, মাইকে নানা চটকদার বিজ্ঞাপন, স্কুল-কলেজে যথেচ্ছা মাইকের ব্যবহার, সময় অসময়ে মাইক ব্যবহার করে উচ্ছস্বরে সভা, সমাবেশ, মিছিল-মিটিং করা একটি নিয়মিত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোথায় কখন মাইক বাজাতে হবে, শব্দ করা যাবে এ নিয়ে কারো কোনোই মাথাব্যাথা নাই। যার যার খুশি মতো যখন তখন মাইক ব্যবহার করে পরিবেমেল „মারাত্মক দূষণ করে চলেছে প্রতিদিন। বিক্রেতার মাইক, রাস্তায় অনিয়ন্ত্রীত পশুদের ঘেউঘেউ শব্দ রোধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নাই। বিয়ে কিংবা জন্মদিনের অনুষ্ঠানে বাড়ির ছাদে প্যান্ডেল টাঙ্গিয়ে বড়বড় সাউন্ডবক্স দিয়ে উচ্চ আওয়াজে মিউজিক বাজানো হচ্ছে হামেশাই। কিন্তু, দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া, ঘর হইতে দুই পা ফেলিয়া। তাই এই শব্দ দূষণ রোধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ কোথাও নেই।
উন্নত বিশ্বের ন্যায়, বাংলাদেশেও শব্দ দূষণ আইন রয়েছে। বাংলাদেশে শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালায় স্পষ্ট বলা আছে কোন এলাকায়, দিনের কোন সময়ে, কি ধরনের শব্দ দূষণ করা আইনত দন্ডনীয় অপরাধ। কিন্তু বাংলাদেশে শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণে যে বিধিমালা রয়েছে সেখানে বিস্তারিত বলা আছে কোন এলাকায়, দিনের কোন সময়ে, কোন ধরনের শব্দের মাত্রা কেমন হবে। আর তা না মেনে চললে সাজার বিধানও রয়েছে।
শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা ২০০৬ অনুযায়ী আবাসিক এলাকায় রাত নটা থেকে ভোর ছটা পর্যন্ত শব্দের মাত্রা ৪৫ ডেসিবেল এবং দিনের অন্য সময়ে ৫৫ ডেসিবেল অতিক্রম করতে পারবে না। বাণিজ্যিক এলাকায় তা যথাক্রমে ৬০ ও ৭০ ডেসিবেল। হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালতের আশপাশে ১০০ মিটার পর্যন্ত নীরব এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা রয়েছে। সেখানে রাতে ৪০ ও দিনে ৫০ ডেসিবেল শব্দ মাত্রা নির্ধারণ করে দেয়া আছে।
বাংলাদেশে মাইকের ব্যাবহার খুবই জনপ্রিয়। লাউড স্পিকারও ব্যবহার হচ্ছে। রাজনৈতিক সভা থেকে শুরু করে বিয়ে, ধর্মীয় অনুষ্ঠান, পিকনিক সকল ক্ষেত্রে এর কানফাটানো শব্দ চলে। তবে আইনে শর্ত সাপেক্ষে এর অনুমতিও রয়েছে। খোলা জায়গায় বিয়ে, খেলাধুলা, কনসার্ট ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, রাজনৈতিক বা অন্য কোন ধরনের সভা, মেলা, যাত্রাগান ইত্যাদির ক্ষেত্রে শব্দের মাত্রা অতিক্রম করে – এমন যন্ত্র ব্যাবহার করা যাবে। তবে তার জন্য কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিতে হবে, পাঁচ ঘণ্টার বেশি সময় এই শব্দ করা যাবে না এবং রাত দশটার মধ্যে এসব অনুষ্ঠান অবশ্যই শেষ করে ফেলতে হবে। পিকনিকের ক্ষেত্রেও কর্তৃপক্ষের নির্ধারিত স্থানে মাইক ও লাউড স্পিকার ব্যবহার করা যাবে। তবে সকাল নটা থেকে বিকেল পাঁচটার পর্যন্ত। তবে আসা-যাওয়ার পথে এগুলো বাজানো যাবে না। আর পিকনিক আয়োজন করতে হবে আবাসিক এলাকা থেকে অন্তত এক কিলোমিটার দুরে।
হর্ন বাজানো সম্ভবত বাংলাদেশে গাড়ি চালকদের বড় বদভ্যাস। ট্রাফিক সিগনাল ও জ্যামে আটকে থাকার সময় সামনে এগুনো যাবে না জেনেও হর্ন বাজান তারা। সামনে কেউ ধীর গতিতে চললে, পথচারীকে উদ্দেশ্য করে প্রতিনিয়ত হর্ন বাজানো হয়। যদিও বিধিমালায় বলা আছে কোন ধরনের মোটরযানে শব্দের মান অতিক্রমকারী হর্ন ব্যাবহার করা যাবে না। নীরব এলাকায় হর্ন বাজানো নিষিদ্ধ। কিন্তু গাড়ির হর্নে রীতিমতো বধিরতার হার বেড়ে গেছে পুরো দেশে। পরিবেশ অধিদফতরের এক জরিপে দেখা যায়, দেশের বিভিন্ন শহরগুলোয় শব্দের মাত্রা ১৩০ ডেসিবেল ছাড়িয়ে গেছে। যা স্বাভাবিক মাত্রার চাইতে আড়াই থেকে তিনগুণ বেশি। আর শব্দের মাত্রা এখন তার থেকে একটুও কমেছে সেটা বলার কোন উপায় নেই।
শব্দ দূষণ আইন ভঙ্গ করলে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা শব্দের উৎস যন্ত্রপাতি জব্দ করতে পারবেন। বিধিমালায় যেসব উল্লেখ করা রয়েছে তা পালনে ব্যর্থতাকে অপরাধ হিসেবে ধরা হবে। শব্দ দূষণে দোষী হিসেবে প্রমাণিত হলে প্রথম অপরাধের জন্য একমাসের কারাদন্ড বা পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা অথবা দু ধরনের দুই প্রদান করার বিধান রয়েছে। দ্বিতীয়বার একই অপরাধ করলে ছয় মাসের কারাদন্ড বা ১০ হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয় দন্ড দেয়ার কথা বলা রয়েছে। শব্দ দূষণের শিকার এমন মনে হলে টেলিফোনে, লিখিত অথবা মৌখিকভাবে কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে প্রতিকার চাইতে পারেন বলেও আইনে উল্লেখ করা হয়েছে।
বাংলাদেশে যে পরিবেশ আদালত রয়েছে তা তিন ধরনের আদালত। যার একটি হচ্ছে মোবাইল কোর্ট। শুধুমাত্র এই কোর্টের মাধ্যমেই শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব বলে বিষেজ্ঞরা মনে করেন। আর বাকি যে দুটো আদালত সেখানে শব্দ দূষণের অভিযোগে কোন মামলার নজির আমি এখনো পর্যন্ত দেখা যায়নি। মানুষের আইন মানার অনীহা তখন তৈরি হয় যখন সে দেখে যে অপরাধ করলে, যেমন রাতের বেলা নির্মাণ কাজ করলে কোন কিছু হয় না। আইন প্রয়োগ না হওয়াটা যখন সমাজের মানুষ দেখতে পায় তখন তারা শব্দ দূষণ বা অন্য কোন অন্যায় করাটা স্বাভাবিক মনে করে।
অনেকেই মনে করেন, সমাজের ড্রাইভিং সিটে য়েছেন রাজনীতিবিদরা। মূলত: তারাই এরকম সংস্কৃতি তৈরির জন্য দায়ী। সমাজের উপরের দিকের লোক, যারা শিল্পপতি, ধনীব্যক্তি, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক দিক দিয়ে যারা ক্ষমতাশালী তারা কোনো আইনই মানতে চাননা। ফলে, তারা যখন এধরনের শব্দ দূষণ ও পরিবেশের মতো বিষয়কে অগ্রাহ্য করেন তখন সাধারণ মানুষও সেটিই অনুসরণ করে।
লম্বা সময় অতিরিক্ত শব্দের মধ্যে থাকার কারণে হাইপার টেনশন, আলসার, হৃদরোগ, মাথাব্যথা, স্মরণশক্তি হ্রাস, স্নায়ুর সমস্যা ও মানসিক চাপ তৈরি হতে পারে। তবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় কান। অতিরিক্ত শব্দের মধ্যে দীর্ঘ দিন কাটালে শ্রবণ শক্তি ধীরে ধীরে কমে যাওয়া এমনকি বধির হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। অতিরিক্ত শব্দের কারণে কানের নার্ভ ও রিসেপ্টর সেলগুলো নষ্ট য়ে যায়। এর ফলে মানুষ ধীরে ধীরে শ্রবণ শক্তি হারাতে থাকে। কত ডেসিবল শব্দে আপনি কতটুকু সময় কাটাচ্ছেন তার উপর বিষয়টি নির্ভর করে। ১২০ ডেসিবেল শব্দ সাথেই সাথে কান নষ্ট করে দিতে পারে। প্রতিদিন দুই ঘণ্টা করে ৮৫ ডেসিবেল শব্দ যদি কোন ব্যক্তির কানে প্রবেশ করে তাহলে তাহলে ধীরে ধীরে শ্রবণশক্তি নষ্ট হবে।
মানুষ সাধারণত ৩০ থেকে ৪০ ডেসিবেল শব্দে কথা বলে। ৭০ ডেসিবেল পর্যন্ত মানুষের কান গ্রহণ করতে পারে। ৮০’র উপরে গেলেই ক্ষতি শুরু হয়। পরিবেশ অধিদফতরের করা এক জরিপে উঠে এসেছে যে মাত্রাতিরিক্ত শব্দের কারণে ইতোমধ্যেই দেশের প্রায় ১২ শতাংশ মানুষের শ্রবণশক্তি হ্রাস পেয়েছে।
উন্নত বিশ্বে শব্দ দূষণ কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়ে থাকে। রাত নয়টার পর পাশের ফ্ল্যাট থেকে জোরে কোনো শব্দ কানে এলে সাথে সাথে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা মুহুর্তের মধ্যে হাজির হয়ে যান ঘটনাস্থলে এবং পরিস্থিতি বুঝে ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকেন। কিন্তু বাংলাদেশে আইন থাকা সত্বেও প্রশাসনের এই বিষয়টির প্রতি কোনই গুরুত্ব নেই। ফেলে শব্দ দূণের মাত্রা বেড়েই চলেছে। আমার হাতে একটা আইওয়াচ রয়েছে। ঘর থেকে বের হলেই মাইকের শব্দ শুনার সাথে সাথেই এই ঘড়ির স্ত্রীনে সাউন্ড এলার্ট ভেসে ওঠে। সতর্কতার জানান দিয়ে নিরব এলাকায় সরে যাবার জন্য বার্তা দেয়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে যাওয়ার জায়গা কোথায়?
শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণে করণীয়ঃ
শব্দ দূষণ নিয়েন্ত্রণের জন্য সরকার, প্রশাসন, শিল্প এবং রাজনৈতিক ও সামাজিক ব্যক্তিবর্গের সম্মিলিত প্রচেষ্টা এবং সচেতনতা প্রয়োজন। তবে, এখানে সবচাইতে বেশি ভ‚মিকা রাখতে পারে প্রশাসন এবং সমাজের কর্তাব্যক্তিবর্গ।
- সভা সমাবেশ ও শব্দ নিয়ন্ত্রণঃ সভা সমাবেশ আয়োজন করার জন্য একটি অনুমোদন পত্র প্রশাসন গ্রহন বা চালু করতে পারে। এই অনুমোদন পত্র বা দরখাস্তেঃ
১. সমাবেশের ধরণ।
২. সমাবেশের উদ্দেশ্য।
৩. সমাবেশ আয়োজক সংগঠনের ৩ জনের নাম, দলীয় পদ, ঠিকানা, ফোন নাম্বার, ইমেইল অ্যাড্রেস ইত্যাদি।
৪. সমাবেশে কী ধরনের সাউন্ড সিস্টেম, স্টেজ সহ অন্যান্য কি কি সরঞ্জাম ব্যবহার করা হবে তার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা।
৫. সমাবেশের নির্দিষ্ট স্থান।
৬. সমাবেশের জায়গা কতটুকু এলাকা জুড়ে হবে তা নির্দিষ্ট করে উল্লেখ করতে হবে।
৭. সমাবেশের সময় কতটুকু হবে? অর্থাৎ সমাবেশ কখন শুরু হবে এবং কখন শেষ হবে।
৮. সমাবেশে আনুমানিক কত মানুষের সমাবেশ ঘটবে।
৯. সমাবেশে কোনো আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটবে কিনা। যদি সমাবেশে কোনো বিশৃঙ্খলা বা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটে থাকতে পারে তার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা এবং এর জন্য দায়ভার নিবে এমন কমপক্ষে ৩জনের নাম, ঠিকানা, দলীয় পদবী, ফোন নাম্বার দরখাস্তে থাকতে হবে।
১০. অনুমোদিত সমাবেশের নির্দিষ্ট জায়গায় বা সীমানায় মাইক স্থাপন করা এবং শব্দের মাত্রা নির্ধারন করে দেওয়া।
১১. আবেদন পত্রে উল্লেখিত সময়ের মধ্যে সমাবেশ শুরু এবং শেষ করা।
১২. সমাবেশের কমপক্ষে ৪৮ ঘন্টা পূর্বে অনুমোদনের জন্য প্রাশাসন বরাবর আবেদপত্র জমা দেওয়া।
১৩. সরকার বা প্রশাসনের অনুমোদ ছাড়া কোনো প্রকার সভা সামাবেশ করতে না দেওয়া।
১৪. মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে জেল-জরিমানা করা।
১৫. জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
- নগর পরিকল্পনা এবং জোনিং: শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণে সুপরিকল্পিত নগর উন্নয়ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শহর পরিকল্পনাকারীদের আবাসিক এলাকা এবং হাইওয়ে এবং শিল্পের মতো কোলাহলপূর্ণ উৎসগুলির মধ্যে বাফার জোন তৈরি করাকে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত। জোনিং আইন আবাসিক এলাকায় কোলাহলপূর্ণ সুবিধা স্থাপন সীমিত করতে পারে, বাসিন্দাদের জন্য একটি শান্ত জীবনযাপনের পরিবেশ নিশ্চিত করে।
- নয়েজ ব্যারিয়ারস এবং সাউন্ডপ্রুফিং: হাইওয়ে এবং রেলপথ বরাবর শব্দ বাধা নির্মাণ করা আশেপাশের মানুষের উপর ট্র্যাফিক শব্দের প্রভাবকে উল্লেখযোগ্যভাবে কমাতে পারে। একইভাবে, সাউন্ডপ্রুফিং বিল্ডিং এবং বাড়িগুলি শান্ত অন্দর স্থান তৈরি করতে সাহায্য করতে পারে, বাইরের শব্দ থেকে বাসিন্দাদের রক্ষা করে। এর মধ্যে শব্দ-শোষণকারী উপকরণ, ডাবল গ্লাজড জানালা এবং দেয়াল ও সিলিং নিরোধক ব্যবহার করা হয়।
- কম-শব্দ প্রযুক্তি প্রয়োগ করা: শিল্প ও নির্মাতাদের শব্দ নির্গমন কমাতে কম-শব্দ প্রযুক্তি এবং যন্ত্রপাতি গ্রহণ করা। উদাহরণস্বরূপ, বৈদ্যুতিক যানবাহনগুলি প্রথাগত দহন ইঞ্জিনগুলির চেয়ে শান্ত, যা ট্র্যাফিক শব্দের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য একটি পরিবেশ-বান্ধব বিকল্প হিসাবে তৈরি করে। গোলমাল হ্রাস প্রযুক্তিতে গবেষণা এবং উন্নয়নকে উৎসাহিত করা ক্ষেত্রে আরও উদ্ভাবন হতে পারে।
- নয়েজ রেগুলেশন প্রয়োগ করা: শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য কঠোর শব্দ বিধি এবং তাদের যথাযথ প্রয়োগ অপরিহার্য। সরকারের উচিত বিভিন্ন ক্ষেত্র এবং ক্রিয়াকলাপের জন্য গ্রহণযোগ্য শব্দের মাত্রা নির্ধারণ করা এবং অ-সম্মতির জন্য শাস্তি কার্যকর করা। শব্দ দূষণকে গুরুত্ব সহকারে নেওয়া হয় তা নিশ্চিত করে কর্তৃপক্ষকে অত্যধিক শব্দের ঘটনা জানাতে সমাজের সদস্যরা ভূমিকা পালন করতে পারে।
- জনসচেতনতা ও শিক্ষা: শব্দ দূষণের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা অত্যাবশ্যক। শিক্ষামূলক প্রচারণা এবং কর্মশালার মাধ্যমে, মানুষ শব্দ কমানোর কৌশল সম্পর্কে শিখতে পারে এবং তাদের দৈনন্দিন জীবনে শব্দের মাত্রা কমানোর গুরুত্ব বুঝতে পারে। জ্ঞানী এবং ক্ষমতাপ্রাপ্ত নাগরিকরা শব্দ দূষণ কমানোর জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করার সম্ভাবনা বেশি।
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, দূষণ ও পরিবেশগত মৃত্যুর ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। বাংলাদেশে পরিবেশ দূষণজনিত অসুস্থতার কারণে প্রতি বছর প্রায় ২৬ শতাংশ মানুষের মৃত্যু হয়, যেখানে বিশ্বব্যাপী এই হার ১৬ শতাংশ। আমেরিকান হার্ট এসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী, শব্দের মাত্রা প্রতি ১০ ডেসিবেল বৃদ্ধিতে যেকোনো বয়সের মানুষের স্ট্রোকের ঝুঁকি ১৪ ভাগ করে বৃদ্ধি পায়। তবে তা ৬৫ বছরের বেশি বয়সের মানুষের ক্ষেত্রে ২৭ ভাগ পর্যন্ত হতে পারে।
টিভি, রেডিও, টেপ রেকর্ডার, মিউজিক সিস্টেম (ডিজে) এর মতো সরঞ্জাম থেকে উৎপন্ন তীব্র শব্দ ও চিৎকারের কারণে শব্দ দূষণ হচ্ছে। এ ছাড়াও বিবাহ, মেলা, পার্টিতে ব্যবহৃত লাউড স্পিকার এবং আতশবাজির ব্যবহারও শব্দ দূষণ করে থাকে। পশুপাখির শব্দ, রাজনৈতিক সভা, সমাবেশ, মিছিল-মিটিং, হাটবাজারসহ বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠান, রাস্তা-ঘাটে যত্রতত্র দলবেঁধে চিৎকার চেঁচামেচি হতে শব্দ দূষণ ঘটে। এ ছাড়াও ভিআইপি গাড়ির অপ্রয়োজনীয় হর্নের ব্যবহার শব্দ দূষণের কারণ হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে ব্যক্তিগত গাড়িতেও ইমার্জেন্সি সাইরেন বাজানোর প্রবণতা উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
বাংলাদেশের সংবিধানের ৩২নং অনুচ্ছেদ জীবনের অধিকারকে মৌলিক অধিকার হিসেবে নিশ্চিত করেছে। এ অনুচ্ছেদে জীবনের অধিকার শুধু টিকে থাকাকে বোঝায় না, বরং মানসম্মত জীবনের নিশ্চয়তা দেয়। এ থেকে বলা যায়, যদি কোনো ব্যক্তি শব্দ দূষণের প্রভাবে তৎক্ষণাৎ বা দীর্ঘ মেয়াদি ক্ষতিগ্রস্ত হন বা তার স্বাভাবিক জীবন ব্যাহত হয়, তাহলে সংবিধানের আলোকে উচ্চ শব্দের বিরুদ্ধে প্রতিকার পাওয়া সম্ভব।
পরিবেশ রক্ষা আইন-১৯৯৫ এর ২০ ধারায় শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য বিধিমালা প্রণয়নের নির্দেশনা মোতাবেক এলাকাভেদে শব্দের মাত্রা নির্দিষ্ট করে শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ মালা-২০০৬ প্রণয়ন করা হয়। এই বিধিমালায় দিন ও রাতকে বিবেচনা করে আবাসিক এলাকা, নীরব এলাকা, মিশ্র এলাকা, বাণিজ্যিক এলাকা এবং শিল্প এলাকায় শব্দের মাত্রা নির্ধারণ করা হয়। একই বিধান দ্য এনভায়রনমেন্টাল কনজারভেশন-১৯৯৭ এর ৪ শিডিউলে বলা হয়েছে। শিডিউল ৫ অনুযায়ী যানবাহনের শব্দের মাত্রাও সুনির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ এর ৪৬ ধারার ৩-এ বলা হয়েছে, পরিবেশ দূষণকারী এমন কোনো যন্ত্র বা যন্ত্রাংশ মোটরযানে ব্যবহার করা যাবে না, যেমন হর্ন বা উচ্চ শব্দের ইঞ্জিন। ধারা ৪৬ এর ৪-এ আরও বলা হয়েছে, কোনো ত্রুটিপূর্ণ, ঝুঁকিপূর্ণ, নিষিদ্ধ বা বিধিনিষেধ আরোপকৃত কোনো মোটরযান সড়ক বা মহাসড়কে চালানোর অনুমতি দেয়া যাবে না।
শব্দ দূষণের বর্তমান অবস্থা খুবই উদ্বেগজনক। সচেতনতার অভাবে ধীরে ধীরে এটি মহামারি আকার ধারণ করছে। অথচ এই সমস্যাটি মানবসৃষ্ট ও সমাধানযোগ্য। একটু আত্মসচেতন ও আইন মেনে চলার প্রবণতাই এই সমস্যা নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম। বিদ্যমান আইনে অতিমাত্রার শব্দ উৎপাত বা দূষণের জন্য জরিমানার বিধানগুলো অপর্যাপ্ত, যা দ্রুত বৃদ্ধি ও বাস্তবায়নের জন্য যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। এ ছাড়া মানুষের প্রতি মানুষকে সহনশীল ও ধৈর্যশীল হতে হবে। অপ্রয়োজনীয় ও যত্রতত্র সবধরনের হর্ন বাজানো বন্ধ করতে হবে, সামাজিক অনুষ্ঠানে অনুষ্ঠানস্থলের মধ্যেই গান বা যন্ত্রের ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। সর্বোপরি মানুষের আচরণগত পরিবর্তন এবং প্রশাসনের কার্যকর পদক্ষেপে শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
– সাংবাদিক, কথাসাহিত্যিক ও ঔপন্যাসিক, লাকসাম।