রাজনীতি-অর্থনীতিতে অনিশ্চয়তা। ব্যবসা-বিনিয়োগে আস্থাহীনতা। উৎপাদন, সরবরাহ ও বিপণনে ধীরগতি। ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা বিদ্যমান আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগে। ব্যবসার প্রসার কিংবা নতুন বিনিয়োগ করা না করা নিয়ে শঙ্কায়। উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে ভোগের চাহিদা কমেছে। পুরো উৎপাদনব্যবস্থায় শ্লথগতির রেশ। ফলে ব্যক্তি কিংবা প্রাতিষ্ঠানিক খাতে লাভ ও মুনাফার চিত্রও সন্তোষজনক নয়। এর প্রভাব পড়েছে রাজস্ব আয়ে। আগের সরকার উচ্চাভিলাষী রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা দিয়ে গণ-অভ্যুত্থানে গদি ছাড়া হলেও তাদের রেখে যাওয়া টার্গেট অনুযায়ী কাঙ্ক্ষিত রাজস্ব আসছে না। বরং রাজস্ব আয় বড় ধরনের ঘাটতির পথে। অর্থবছরের ছয় মাসেই রাজস্ব আয়ে টানাটানি চলছে।
ঘাটতি ছাড়িয়েছে প্রায় ৫৮ হাজার কোটি টাকা। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য বলছে, অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) এনবিআরের মোট রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ছিল দুই লাখ ১৪ হাজার ১৪৩ কোটি টাকা। এর বিপরীতে আদায় হয়েছে এক লাখ ৫৬ হাজার ৪১৯ কোটি টাকা। এ সময় আমদানি শুল্ক, মূল্য সংযোজন কর (মূসক বা ভ্যাট) ও আয়কর—এই তিন খাতের কোনোটিতেই লক্ষ্য পূরণ হয়নি। তিন খাতেই লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে রাজস্ব আদায় কমেছে।
আলোচ্য সময়ে সবচেয়ে বেশি ঘাটতি হয়েছে আয়কর খাতে। ছয় মাসে ঘাটতি হয়েছে ২৪ হাজার কোটি টাকার মতো। এই খাতে আদায়ের লক্ষ্য ছিল ৭৬ হাজার ৬৭ কোটি টাকা। এ সময়ে আদায় হয়েছে ৫২ হাজার ১৬২ কোটি টাকা। এ সময় ভ্যাট বা মূসক আদায়ে ঘাটতি হয়েছে ২১ হাজার কোটি টাকা। ভ্যাট আদায় হয়েছে ৫৫ হাজার ১৭৭ কোটি টাকা। এ সময়ে এই খাতের লক্ষ্য ছিল ৭৬ হাজার ৩১৭ কোটি টাকা। আমদানি খাতে ৬১ হাজার ৯৫২ কোটি টাকার লক্ষ্যের বিপরীতে আদায় হয়েছে ৪৯ হাজার ৮০ কোটি টাকা। এই খাতে ঘাটতি হয়েছে প্রায় ১৩ হাজার কোটি টাকা।
আয়কর খাতে ১৩ হাজার কোটি টাকা ঘাটতির পেছনে মূল কারণ এই সময়ে আয়ের সুযোগই তৈরি হয়নি। ব্যবসা-বাণিজ্য সীমিত থাকায় এই খাতে তার প্রভাব পড়েছে। এ ছাড়া আমদানি কমে যাওয়ায় অগ্রিম আয়কর আদায়ও কমেছে। রাজস্ব আদায়ে বড় অবদান রাখে ভ্যাট খাত। আমদানি, স্থানীয় পর্যায়ে উৎপাদন, সরবরাহ ও জোগানদার পর্যায় পর্যন্ত এই খাতের বিস্তৃতি। এর সর্বশেষ ধাপ ক্রেতা বা ভোক্তা। আমদানি, উৎপাদন, সরবরাহের পাশাপাশি উৎপাদন কমে যাওয়ার ফলে এই খাত বড় ধাক্কা খেয়েছে।
এ ছাড়া ব্যাংকে টাকা রাখার ওপর আবগারি শুল্ক আদায় করে এনবিআর। তবে উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে ব্যাংকে গচ্ছিত টাকার পরিমাণ কমায় আবগারি শুল্কেও পড়েছে এর প্রভাব। শিল্প কাঁচামাল ও পণ্য আমদানি কমে যাওয়ায় আমদানি শুল্ক আদায়ে ঘাটতি দেখা গেছে। ব্যবসা-বাণিজ্য পরিস্থিতির উন্নতি না হলে আমদানি সহজে বাড়বে না। কিছু ভোগ্য পণ্য আমদানিতে শুল্কছাড় দেওয়ায়ও এই খাতে আদায় টাকা কমেছে।
জুলাই মাসের শুরু থেকে আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত দেশজুড়ে ছাত্র-জনতার আন্দোলন হয়। তখন প্রায় সব কিছু বন্ধ ছিল বললেই চলে। সাধারণ ছুটির পাশাপাশি কারফিউও ছিল বেশ কয়েক দিন। এসবের প্রভাব পড়েছে শুল্ক-কর আদায়ে। আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে সরকার পরিবর্তনের পরও আবার ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। যে কারণে কাঙ্ক্ষিত হারে রাজস্ব আদায় করা যায়নি বলে জানান এনবিআরের শুল্ক ও কর বিভাগের কর্মকর্তারা।
পটপরিবর্তনের পর এখনো রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা কাটেনি। এর প্রভাব পড়েছে দেশের অর্থনীতিতে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই রাজস্ব আদায় কমেছে। এ ছাড়া উচ্চ মূল্যস্ফীতির জেরে ক্রেতাদের ব্যয় মেটাতে হিমশিম খাওয়ার প্রেক্ষাপটে কমে গেছে ভোগ। ফলে কমেছে উৎপাদনও। এ ছাড়া ডলার সংকটের জেরে এলসি খুলতে না পারা, বেশ কিছু শিল্প গ্রুপ বন্ধ হয়ে যাওয়া ও কার্যক্রম সীমিত করা, শিল্প মালিকদের বিরুদ্ধে মামলা, নতুন বিনিয়োগ না আসায় চাপ আরো বাড়তে পারে বলে মত অর্থনীতিবিদ ও খাতসংশ্লিষ্টদের।
জানতে চাইলে শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির সদস্য ও বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো নির্বিঘ্নে চলতে পারছে—এমন অবস্থা তৈরি হয়নি। মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় মানুষও কেনাকাটা করতে পারছে না। এখনো আমরা পুরোপুরি স্বাভাবিক অবস্থায় আসতে পারিনি। এটাই প্রধান কারণ। আমাদের রাজস্ব আদায়ের মূল জায়গা পরোক্ষ কর। ব্যবসা-বাণিজ্য ঠিকভাবে না চললে এবং মানুষ কেনাকাটা না করলে, সেটা আদায় হবে না।’
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘জুলাই-আগস্টে আন্দোলনের ফলে অর্থনীতিতে একটা চাপ পড়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্য এখনো ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না। এ ছাড়া এনবিআরকে দেওয়া রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রাও সক্ষমতার চেয়ে বেশি। করজাল সম্প্রসারণ করে এই ঘাটতি পূরণের পরামর্শ দেন তিনি।’
নিট পোশাক মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘ব্যবসা-বাণিজ্য যেহেতু খারাপ, অর্থনীতি স্বাভাবিকভাবেই খারাপ হবে। এই খারাপের মধ্যে বাংলাদেশ সরকারের নীতিগুলো আরো খারাপের দিকে নিয়ে গেছে। এই খারাপ সময়ে যে নীতি প্রণয়ন করা দরকার ছিল, তা না হয়ে উল্টোটা হচ্ছে।’
চলতি অর্থবছরে এনবিআরের জন্য সব মিলিয়ে চার লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে হলে অর্থবছরের বাকি ছয় মাসে তিন লাখ ২৪ হাজার কোটি টাকা আদায় করতে হবে। সে হিসাবে প্রতি মাসে গড়ে আদায় করতে হবে ৫৪ হাজার কোটি টাকা। এই লক্ষ্যপূরণকে অসম্ভব বলে মনে করছেন এনবিআরের কর্মকর্তারাই। যদিও সর্বোচ্চ আদায়ের চেষ্টা করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন তাঁরা।