শিব্বীর আহমেদঃ হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শৈশব, কৈশোর কেটেছে পারিবারিক ধর্মিয় আবহে। পিতা শেখ লুৎফুর রহমান ছিলেন সীমাহিন আলেমভক্ত ও ধার্মিক ব্যক্তিত্ব। যৌবন বয়সে বঙ্গবন্ধু রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েছিলেন দুই আলেমের হাত ধরে। এর মধ্যে অন্যতম ছিলেন ছিলেন মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী(রহ.)। ইতিহাস প্রমাণ করে, আলেমদের সাথে বঙ্গবন্ধুর অন্য রকম এক সুগভীর সুসম্পর্ক ছিল।
শামসুল হক ফরিদপুরী(রহ.) একজন বাংলাদেশী ইসলামি চিন্তাবিদ, প্রখ্যাত আলেম, সমাজ-সংস্কারক ও ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব। তিনি লালবাগ জামিয়া কুরআনিয়া আরাবিয়া কওমি মাদ্রাসা সহ গওহরডাঙ্গা কওমি মাদ্রাসা, ফরিদাবাদ কওমি মাদ্রাসা এবং বড় কাটারা কওমি মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা। তিনি ছিলেন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সক্রিয় নেতা। ১৮৯৬ সালের ১৫ ফেব্রæয়ারি তিনি গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়া উপজেলার পাটগাতি ইউনিয়নের ঘোপেরডাঙ্গা (গওহরডাঙ্গা) গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পূর্বপুরুষগণ প্রায় তিনশো বছর পূর্বে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে মধ্যপ্রাচ্য থেকে বাংলায় আগমন করেন। তাঁর পিতার নাম মুন্সি মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ এবং মাতার নাম আমেনা খাতুন। তার পিতা মুন্সি আবদুল্লাহ ১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দে সিপাহী বিপ্লবে এবং তার দাদা চেরাগ আলী সৈয়দ আহমদ শহীদ শিখ-ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন।
বঙ্গবন্ধুর আত্মিয় সূত্রে দাদা ছিলেন মাওলানা শামছুল হক ফরিদপুরী রহমতুল্লাহ আলাইহি। তিনি যখন লালবাগ মাদরাসার মুহতামিম (প্রকাশক, পরিচালক, তত্ত¡বধায়ক), তখন শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকার রাজনীতিতে তরুন নেতা। তিনি ছিলেন দাদাহুজুর মাওলানা শামছুল হক ফরিদপুরী রহমতুল্লাহ আলাইহির একান্ত ভক্ত। সপ্তাহে কয়েকবার দাদাহুজুরকে দেখতে তখন প্রায়শই লালবাগে যেতেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ফলে তৎকালিন ফরিদপুরী রহমতুল্লাহ আলাইহির সমসাময়িক অনেক আলেমকে তিনি সম্মানের সহিত দাদাজি বলে সম্বোধন করতেন। পারিবারিক আবহে ছোটবেলা থেকেই আলেমদের সাথে সুগভীর এক সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে শেখ মুজিবুর রহমানের।
মাওলানা আতাউর রহমান খান (কিশোরগঞ্জের সাবেক এমপি) তাঁর এক স্মৃতিচারণে লিখেছেন, ‘‘গাড়ি ইত্তেফাক অফিসের সামনে দাঁড় করিয়ে ড্রাইভার বাদে আমরা সবাই শায়েখদ্বয়ের (মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী এবং মাওলানা আতাহার আলী) পেছনে পেছনে গেলাম। তাঁরা খোঁজ করছিলেন শেখ মুজিবুর রহমানকে। মুজিবুর রহমান সাহেব তখন বড় কোনো নেতা ছিলেন না। তবে ছাত্র নেতা হিসেবে এবং জাতীয় নেতাদের কাছে যাতায়াত করতেন বলে শেখ মুজিব অনেক কিছুই করতে পারতেন। আমরা অফিসের অনেক পিছনের এক রুমের দরজায় দাঁড়িয়ে দেখতে পেলাম, কয়েকজন লোক গল্পগুজবে মত্ত। আমরা গিয়ে দাঁড়াতেই শেখ মুজিব সাহেব চেয়ার ছেড়ে হন্তদন্ত অবস্থায় এগিয়ে এলেন। আর বিস্মিত কণ্ঠে বলতে লাগলেন, ‘আরে, দাদাহুজুর আপনি এখানে! দাদা এখানে কোনো খবর না দিয়েই সরাসরি উপস্থিত। কোনো দরকার হলে আমাকে খবর দিলেই তো আমি উপস্থিত হতাম।’ মুজেিবর কথায় দাদা আতাহার আলী সাহেব উত্তর দিয়ে বললেন, ‘আরে না না, খবর দেয়ার হলে তোমাকে খবরই দিতাম। এখানেই প্রয়োজন।’ এরপর শেখ সাহেব তাঁর অন্যান্য বন্ধু-বান্ধবদের পরিচয় করিয়ে দিয়ে, সদর সাহেব এবং আতাহার আলী সাহেবকে বসালেন।’’ (হযরত ফরিদপুরী (র.)-এর সান্নিধ্যে কিছুক্ষণ, মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী (র.) স্মারক গ্রন্থ, প্রকাশ ১৯৯৯ ইংরেজি)।
মুজিবকোট হচ্ছে পুরুষদের জন্য তৈরি এক ধরনের কালো কোট। এটি একটি হাতাকাটা, উঁচু-গলা বিশিষ্ট ও নিম্ন অংশে দুটি পকেট ও পাঁচ বা ছয় বোতাম সমেত নকশাকৃত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক ব্যবহৃত একটি পোশাক। অনেকের ধারনা, মুজিবকোট মূলত নেহরু জ্যাকেটের একটি সংস্করণ, যা ১৯৪৭ থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহ্রু পরতেন। কিন্তু নেহরুর পোশাকটি মূলত ভারতের উত্তরাঞ্চলে প্রচলিত আচকানের একটি রূপ। আবার অনেকের মতে, শেখ মুজিব ছয় বোতাম বিশিষ্ট এই কোটটি পরতেন, যা ১৯৬৬-এর ছয়-দফা দাবীর সাথে সম্পর্কিত। তবে, বঙ্গবন্ধুর কিছু ঘনিষ্ঠজন এবং প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতাদের দাবি, ‘মুজিব কোট এবং ছয় দফা সনদের মধ্যে কোনও সম্পর্ক নেই।’
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এই কোটটি কবে থেকে পরতে শুরু করেছিলেন তা নিয়েও রয়েছে মতভেদ। অনেকের মতে, ১৯৪৯ সালে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরে তিনি এই কোটটি পরতে শুরু করেন। মাওলানা ভাসানী এবং শামসুল হক যখন আওয়ামী মুসলীম লীগ প্রতিষ্ঠা করলেন তখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সংগঠনটির যুগ্ন সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন। ধারণা করা হয়, তখন থেকেই বঙ্গবন্ধুকে এই কোট পরতে দেখা যায়। তবে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় মুজিবের আইনজীবী ড. কামাল হোসেনের মতে, ‘১৯৬৮ সাল থেকে মুজিব এই স্বতন্ত্র নকশার পোশাকটি পরতে শুরু করেছিলেন।’
স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে যা যা প্রিয় ছিল, তা এই দেশের সকল মুক্তিকামী মানুষের কাছে প্রিয় হয়ে উঠেছে। বঙ্গবন্ধুর বিশেষ পোশাক ছিল সাদা পাঞ্জাবি-পায়জামা আর ৬ বোতামের হাতাকাটা কালো কোট। এই হাতাকাটা কালো কোটটি পরবর্তীতে মানুষের মুখেমুখে ‘মুজিবকোট’ নামে পরিচিতি লাভ করে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ এবং তাঁকে যারা ভালোবাসেন তারাই পরবর্তিতে এই ‘মুজিবকোট’ ব্যবহার করা শুরু করেন।
তবে আধুনিক যুগের রাজনীতিবিদদের মধ্যে এই কোটটি বিপুল জনপ্রিয়। এটি এখন একটি আইকন হিসাবে স্বীকৃত। বিশেষত আওয়ামী লীগের নেতারা বঙ্গবন্ধুর প্রতি ভালোবাসা, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও ঐতিহ্য ধারণের অংশ হিসাবে মুজিব কোট ব্যবহার করেন। বর্তমান তরুণ প্রজন্ম বিভিন্ন ধরনের শৈলীসহ এই কোট পরিধান করে থাকে। কিন্তু সত্যিকার অর্থে মুজিবের কাছে এই কোটটি কিভাবে এল এই ইতিহাস অনেকের কাছেই এখনো অজানাই রয়ে গেছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দাদাহুজুর আল্লামা শাসছুল হক ফরিদপুরী সব সময় পানজাবির উপরে হাতাকাটা কালো কোট পড়তেন। এই কোট কখনো পাঁচ বোতাম, আবার কখনো ছয় বোতামের ছিল। পঞ্চাশের দশকের কোনো একদিন লালবাগে দাদাহুজুরের কামরায় বসে ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। দাদাহুজুরের গায়ে ছয় বোতামের কালো কোট দেখে মুজিব বললেন, ‘দাদা আপনার এই কালো কোট আমার খুব ভালো লাগে।’ মুজিবের কথা শুনে সাথে সাথে দাদাহুজুর নিজের পরনের কালো কোটটি খুলে নাতি মুজিবকে পরিয়ে দিলেন। তারপর মুজিবের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘বাহ! দারুন লাগছে তো নেতাকে। এখন তোমাকে মনে হচ্ছে সত্যকারের একজন জাতীয় নেতা। ঠিক আছে এই কোট তোমাকে দিয়ে দিলাম। তুমি সব সময় এটা পরে মিটিং মিছিলে যাবে।’
দাদাহুজুরের কাছ থেকে প্রশংসা পেয়ে নাতি শেখ মুজিবুর রহমান অত্যন্ত খুশি হলেন। তারপর থেকেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দাদাহুজুরের দেয়া এই কালো কোট পরা শুরু করলেন। কোনো উদ্দেশ্যে বা আদর্শকে সামনে নিয়ে শেখ মুজিব এই কোট পরা শুরু করেননি। বরং দাদাহুজুর এবং আলেমদের প্রতি বঙ্গবন্ধুর গভীর ভালোবাসা থেকেই বঙ্গবন্ধু তাঁর দাদাহুজুরের দেয়া উপহার এই কালো কোট পরা শুরু করেন। দাদাহুজুরের ভালোবাসা ও নির্দেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সব সময় গুরুত্বপূর্ণ মিটিং সভা সমাবেশে এই হাতাকাটা কালো কোট পরেই যেতেন। ঐতিহাসিক ৭ মার্চ ভাষণের দিনও তিনি এই কালো কোট পরিহিত ছিলেন। দাদাহুজুরের প্রতি ভালোবাসা, আলেম সমাজের প্রতি শ্রদ্ধা ও বরকতের ফলে আমৃত্যু এই কালো কোট ছিল বঙ্গবন্ধুর নিত্যসঙ্গি এবং বঙ্গবন্ধুর প্রিয় পোশাক। যা পরবর্তিতে জনতার মুখেমুখেই মুজিবকোট হিসাবে পরিচিতি লাভ করে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের এক ছাত্র তার সহপাঠী তাজউদ্দিনকে সঙ্গে নিয়ে শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে দেখা দিতে গিয়েছিলেন। তিনি শেখ মুজিবুর রহমানকে অনেক কাছ থেকে দেখলেন। কথাও বললেন দীর্ঘক্ষণ। কথা শেষে ওঠে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু যখন তার কালো কোটটি গায়ে জড়াচ্ছিলেন তখন ওই ছাত্র লক্ষ্য করলেন কোটে ৬টি বোতাম রয়েছে। তিনি বঙ্গবন্ধুকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনার কোটের বোতাম ৬টি কেন?’ উত্তরে বঙ্গবন্ধু তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘এমন প্রশ্ন এর আগে আমাকে আর কেউ করেনি। তুই প্রথম। এই ৬টি বোতাম আমার ঘোষিত ৬ দফার প্রতীক।’
কিন্তু মূলত: শেখ মুজিব এই কোট পরা শুরু করেন পঞ্চাশ দশকের দিকে দাদাহুজুরের কাছ থেকে উপহার পেয়ে। তখন বাঙালির মুক্তিরসনদ মুজিবের ঐতিহাসিক ছয় দফা দাবী শুরুই হয়নি। ১৯৬৬ সালে ছয়দফা প্রবর্তনের পরও ছয় দফার সাথে মুজিবকোটের ছয় বোতামের কোনোই সম্পর্ক ছিলনা। বরং স্বাধীনতার পর মুজিবকোটের ছয় বোতাম বাঙালির মুক্তিরসনদ ঐতিহাসিক ছয়দফার চিহ্ন হিসাবেই গণ্য হতে শুরু করে সাধারণ মানুষের কাছে। স্বাধীনতার পর থেকেই মুজিবকোটের ছয় বোতাম মানেই শেখ মুজিবের ছয় দফা।
বঙ্গবন্ধুর মুজিবকোটের আরেকটা বিশেষত্ব, কলারের ভেতরে বোতাম দিয়ে আটকানো আলাদা কাপড়ের ডাবল কলার। কলার বেশি ময়লা হয় বলেই মনে হয় এই ব্যবস্থা। ডিজাইনার বদরুন নাহার জানিয়েছেন, ‘বঙ্গবন্ধুর প্রথম মুজিবকোট বানিয়েছিলেন খাদি কাপড় দিয়ে। সেলাই করে দিয়েছিল ১৬ বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ের নিউ লাহোর টেইলার্স। এই টেইলার্স থেকেই সাধারণত বঙ্গবন্ধুর কাপড় সেলাই হতো।’ ইংল্যান্ডে গিয়ে সেভিল রয় টেইলার্স থেকেও একবার এই কোট বানিয়ে এনেছিলেন বঙ্গবন্ধু। স্বাধীনতা ঘোষণার পূর্বে শেখ মুজিবের গায়ের কোটটি মুজিবকোট হিসেবে তেমন খ্যাতি লাভ করেনি। কালো হাতাকাটা এই বিখ্যাত কোটটি তখনও লাভ করেনি কালজয়ী কোনো নাম।
স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু এই মুজিবকোট পরেই গুরুত্বপূর্ণ সব সভা সমাবেশে, মাহফিলে অংশগ্রহণ করেছেন, ভাষণ দিয়েছেন। বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন এই কালোকোট পরেই। দাদাহুজুরের দেয়া উপহার কালো কোট ধীরে ধীরে বাঙালির ফ্যাশন আইকন হিসেবে মানুষের মুখে মুখেই বিশ্বের দরবারে দাদাহুজুরের দেয়া উপহার কালো কোটের নাম ছড়িয়ে পড়ে মুজিবকোট হিসাবেই। তারপর থেকেই মুজিবকোটের ছয় বোতাম মানেই শেখ মুজিবের ছয় দফা।
মূলত: মুজিবকোটের সাথে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ছয় দফার কোনো সম্পর্ক নাই। নেহরু জ্যাকেটের সাথেও এর কোনো সম্পর্ক নাই। মুজিবকোট মূলত: মুজিবের প্রতি দাদাহুজুরের ভালোবাসার এক অপুর্ব নিদর্শন। কিন্তু সাধারণ মানুষ কাছে দাদাহুজুর প্রতি, আলেমদের প্রতি বঙ্গবন্ধুর এই প্রেমময় কাহিনী কজনই জানে। মুজিবের বিখ্যাত ‘মুজিবকোট’ মূলত মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী(রহ.) এর কোট ছিল। বঙ্গবন্ধুর শরীরে সারা জীবন জড়িয়ে ছিল এদেশের সর্বজন শ্রদ্ধেয় বুর্যুগ আলেমদের ভালোবাসা।
– কথাসাহিত্যিক-ঔপন্যাাসিক।