বাঙালি মন! বাঙালি চরিত!

শিব্বীর আহমেদঃ বিশ্বে বাঙালিরা, বিশেষ করে বাংলাদেশি বাঙালিরা এক অদ্ভুত রকমের জায়গা করে নিয়েছে। বাঙালিদের নিয়ে নানা মুখরোচক গল্প মানুষের মুখে মুখে উদাহরন হিসাবে বিশে^ আলোচিত সমালোচিত। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাঙালিকে উদ্দেশ্য করে লিখেছিলেন, ‘রেখেছ বাঙালি করে, মানুষ কর নি’। বাঙালি এক মজার জাতি। কটাক্ষ এবং সমালোচনায় বাঙালি মারমুখো। মতদ্বৈততা এবং দ্বিধা তার স্বভাবসুলভ মানসিকতা। কবি নির্মলেন্দু গুণ তার এক কবিতায় এই প্রশ্নটা খানিক ভিন্নভাবে করেছিলেন, ‘এতই যদি দ্বিধা তবে জন্মেছিলে কেন?’ আবার এই দ্বিধাও সবসময় থাকে না। বাঙালিদের মেনে নেওয়াটাই হয়তো নিয়ামক হয়ে দাঁড়ায়।

ছেলেবেলায় আদর্শলিপি বইতে আদর্শ মানুষ হয়ে উযঠবার জন্য ছড়া পড়েছিলাম। ‘সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি, সারাদিন আমি যেন ভালো হয়ে চলি’। এই ছড়ার মাঝে ভালো হয়ে চলার নির্দেশ আছে। সেহেতু এই ছড়াটি আদর্শ ছড়া হিসেবে গণ্য হতো। কিন্তু এখন আর এই ছড়াটিকে আদর্শ বলে মনে হয় না। যে সমাজের লোকজনকে প্রতিদিন সকালে ভালো থাকার জন্য নিজেকে অটোসাজেশন দিতে হয়, সে সমাজের লোকজন আদতেই খারাপ। তাদের চরিত্র বলে কিছু নেই। আমরা এখন সবাইকে জানিয়ে চুরি করি। ঘুষ খাই। খুন করি। গুম করি। যা ইচ্ছে তাই করি। আমাদেও দৈনন্দিন কর্মকান্ডে নেতা থাকে, নেত্রী থাকে, কর্মী থাকে, দালাল থাকে, মাস্তান থাকে। ষড়ন্ত্রকারীরাও থাকে। আসলে আমরা সবাই এখন ঘুষ, দুর্নীতি আর ষযড়যন্ত্রের জন্য একেক জন এক মহা ওস্তাদ হয়ে গেছি। বাঙালি জাতি তার নিজস্ব বৃত্তের ভেতর থেকে বের হতে পারেনি। অনেকটা ‘আপনা মাংসে হরিণা বৈরীর’ মতো। পরিচিত বৃত্তের বাঙালির সাধারণ আচরণকে তারা সমগ্র বাঙালি জাতির জন্য প্রয়োগ করেছেন।

হুমায়ুন আজাদ তাঁর নির্বাচিত প্রবন্ধে বাঙালি চরিত্রের স্বরূপ উদঘাটন করেছেন এভাবে ‘… বাঙালি পৃথিবীর সবচেয়ে অহমিকাপরায়ণ জাতিগুলোর একটি, বাস করে পৃথিবীর এক কোণে; ছোটো, জুতোর গুহার মতো, ভূভাগে; খুবই দরিদ্র এখন পৃথিবীর দরিদ্রতম। তার দেশ ছোটো; ছোটো ভূভাগে বাস করার একটি ফল মানসিকভাবে ছোটো, সংকীর্ণ হওয়া; ক‚পমন্ডুকতায় ভোগা, যাতে ভুগছে বাঙালি অনেক শতাব্দী ধরে। বাঙালির এক অংশ পড়ে আছে এক বড় দেশের এক প্রান্তে ভুগছে প্রান্তিক মানসিকতায়; এবং আরেক দারিদ্র বিশ শতকের বড়ো কিংবদন্তি ও সত্য। আর্থিক দারিদ্র্য মানুষকে মানসিকভাবে গরিব করে, বাঙালির মনের পরিচয় নিলে তা বোঝা যায়। ইতিহাসে বাঙালির যে-পরিচয় পাওয়া যায় তা গৌরবজনক নয়; এবং এখন যে-পরিচয় পাই বাঙালির, তা আরও অগৌরবের। প্রতিটি জনগোষ্ঠীর রয়েছে একটি বিশেষ চরিত্র, যা দিয়ে তাকে শনাক্ত করা যায়; কিন্তু বাঙালির পাওয়া যায় না এমন বৈশিষ্ট্য, যার দিকে নির্দেশ করে বলা যায় এ হচ্ছে বাঙালিত্ব। প্রতিটি জনগোষ্ঠীর স্বভাবের রয়েছে একটি-দুটি প্রশংসনীয় বৈশিষ্ট্য; কোন জাতি সরল, কোন জাতি পরোপকারী, কোন জনগোষ্ঠী উদার, বা মহৎ, বা আন্তরিক, বা কোন জাতি স্বল্পভাষী, বা বিনয়ী, বা পরিশ্রমী, বা উচ্চাভিলাষী; কিন্তু বাঙালির নেই এমন কোন গুণ, যার সংস্পর্শে এসে মনুষ্যত্বের প্রসার ঘটাতে পারে। বাঙালির জাতিকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে পর্যবেক্ষণ ও বিচার করা হয়েছে কি না, তা জানি না আমি; কিন্তু বোধ করি যে তা এখন জরুরি। (হুমায়ুন আজাদ নির্বাচিত প্রবন্ধ পৃষ্ঠা ২৫৪)।

দ্বিতীয় ধারার মনীষি যারা আছেন, তারা বাঙালির অজশ্র সীমাবদ্ধতাকে পর্যবেক্ষণ করেও অকৃত্রিম ভালোবাসায় জাতিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সহায়তা করেছেন। বঙ্গবন্ধু, রবীন্দ্রনাথ, নজরুলসহ অজস্র মানুষ আছেন এ ধারায়। প্রশ্ন হলো অনেকেই হয়তো বলতে পারেন বুদ্ধিবৃত্তিক অবস্থান থেকে জাতিকে পথ দেখানোর জন্য, প্রথম ধারার মনীষীরা, বিশ্লেষণে নির্মাতা দেখিয়েছেন কিন্তু তাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য মহৎ ছিল। এ রকম প্রতিক্রিয়ার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করা যায় না। কিন্তু ‘গরু মেরে জুতা দান’ করলে, জুতা দানের উদ্দেশ্য কতটুকু মহৎ থাকে সে বিষয়টিকে সাহসীভাবে বিশ্লেষণের সময় এসেছে। এ ধারার মানুষদের পান্ডিত্য, জ্ঞান, নিয়ে প্রশ্ন তোলার অবকাশ নেই। জাতিকে পথ দেখানোর ইচ্ছাকেও শ্রদ্ধা করতে হয়। নীতি শাস্ত্রে একটি বিষয়কে খুব গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয় সেটি হলো, উদ্দেশ্য সাধনের উপায়।

বঙ্গবন্ধু যেভাবে বাঙালি জাতির হৃদয়ে প্রবেশ করতে সমর্থ হয়েছিলেন এবং মানুষের ভালোবাসাকে ধারণ করে, মানুষের অন্তরের বেদনাকে অনুভব করে তিনি উঠে এসেছিলেন বাংলার গহীন গ্রাম থেকে; এ রকম অনন্য বাঙালি যে বিরল, ইতিহাস তা’ স্বাক্ষ্য দেয়। বঙ্গবন্ধু তার চলার পথে বাঙালি জাতির সীমাবদ্ধতাকে লক্ষ্য করেছেন এবং তার নিজস্ব পর্যবেক্ষণ ও মন্তব্য, বঙ্গবন্ধুর লেখায় ও বক্তব্যে আমরা দেখতে পাই। তার লেখা অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে এ রকম দু-একটি পর্যবেক্ষণ দেখতে পাওয়া যায়। বঙ্গবন্ধুর একটি উল্লেখযোগ্য পর্যবেক্ষণ লক্ষ্য করলে দেখা যায় কত সহজভাবে তিনি তার অভিজ্ঞতালব্ধ শিক্ষা তুলে ধরেছেন। অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে তিনি লিখেছেন, ‘… পরশ্রীকাতরতা এবং বিশ্বাসঘাতকতা আমাদের রক্তের মধ্যে রয়েছে। বোধহয় দুনিয়ার কোন ভাষায়ই এই কথাটা পাওয়া যাবে না, পরশ্রীকাতরতা’। পরের শ্রী দেখে যে কাতর হয়, তাকে ‘পরশ্রীকাতর’ বলে। ঈর্ষা, দ্বেষ সব ভাষায়ই পাবেন, সব জাতির মধ্যেই কিছু কিছু আছে, কিন্তু বাঙালিদের মধ্যে আছে পরশ্রীকাতরতা। ভাই, ভাইয়ের উন্নতি দেখলে খুশি হয় না। এই জন্যই বাঙালি জাতির সব রকম গুণ থাকা সত্তে¡ও জীবনভর অন্যের অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে। সুজলা, সুফলা বাংলাদেশ সম্পদে ভর্তি। এমন উর্বর জমি দুনিয়ায় খুব অল্প দেশেই আছে। তবুও এরা গরিব। কারণ, যুগ যুগ ধরে এরা শোষিত হয়েছে নিজের দোষে।’

এটি বঙ্গবন্ধুর অত্যন্ত সরল উপলব্ধি। বঙ্গবন্ধু বাঙালির কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস নিয়েও কথা বলেছেন। আমরা অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে বাঙালির অন্ধবিশ্বাস নিয়েও কিছু কথা শুনতে পাই। বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত স্বতঃস্ফূর্ত এবং আন্তরিকভাবে তার বক্তব্য উপস্থাপনা করেছেন, তার উপস্থাপনা পাঠকের কাছে দিকনির্দেশনার মতো মনে হয়। বাঙালির পরশ্রীকাতরতা বিষয়ে তার মন্তব্য দেখে মনে হয়, স্নেহে পরিপূর্ণ একজন মানুষ জাতিকে পরিবার ভেবে সে পরিবারকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য অভিমানে কথাগুলো বলছেন।

আমাদের জাতীয় কবি সাহিত্য ও ব্যক্তি জীবন নিয়ে বাঙালির প্রধান দুটি সম্প্রদায়ের দ্বারা নিষ্ঠুরভাবে সমালোচিত হয়েছিলেন। তিনি মানুষ হওয়ার জন্য সবাইকে দিক নির্দেশনা প্রদান করেছেন। কোথাও অসৌজন্যমূলকভাবে জাতিকে মূল্যায়ন করে কোন মন্তব্য করতে দেখিনি তাকে। তার ব্যক্তিজীবন ও অসামান্য সৃষ্টিকর্মকে যেভাবে কষাঘাত করা হয়েছে সাধারণ মানুষ হলে বাঙালি জাতি চরিত্রের স্বরূপকে তিনি নির্দয়ভাবে উপস্থাপনা করতে পারতেন। মহৎ কবি তার মহত্ব দিয়ে, জাতির কাছে অনুনয় করে নিবেদন করেন এভাবে কেউ বলেন আমার বাণী যবন, কেউ বলেন কাফের। আমি বলি, ও দুটোর কোনটাই নয়। আমি শুধু হিন্দু-মুসলমানকে এক জায়গায় ধরে এনে হ্যান্ডশেক করাবার চেষ্টা করেছি; গালাগালিকে গলাগলিতে পরিণত করার চেষ্টা করেছি। সে হাতে হাত মিলানো যদি হাতাহাতির চেয়ে অশোভনীয় হয়ে থাকে, তাহলে ওরা আপনি আলাদা হয়ে যাবে। … মানুষের জীবনে এক দিকে কঠোর দারিদ্র্য-ঋণ-অভাব; অন্যদিকে লোভী অসুরের যক্ষের ব্যাংকে কোটি কোটি টাকা পাষাণ স্তূপের মতো জমা হয়ে আছে। এ অসাম্য ভেদজ্ঞান দূর করতেই আমি এসেছিলাম।” ১৯৪১ সালের ৬ এপ্রিল মুসলিম ইনস্টিটিউট হলে ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি’র রজতজয়ন্তী উৎসব অনুষ্ঠানে সভাপতি রূপে কাজী নজরুল ইসলাম এই অভিভাষণ দান করেন। উল্লেখ্য অভিভাষণটির শুরুতে তিনি বন্ধুগণ বলে সবাইকে সম্বোধন করেন।

বাঙালি চরিত্রের জটিলতা, মনস্তত্ব নিয়ে রবীন্দ্রনাথের নিজের ব্যাখ্যা ছিল এ ধরনের, তিনি ব্যাখ্যা করে দেখিয়েছেন … ‘আমরা আরম্ভ করি শেষ করি না; আড়ম্বর করি, কাজ করি না; যাহা অনুষ্ঠান করি, তাহা বিশ্বাস করি না; যাহা বিশ্বাস করি, তাহা পালন করি না; ভূরি পরিমাণ বাক্যরচনা করিতে পারি, তিলপরিমাণ আত্মত্যাগ করিতে পারি না। আমরা অহংকার দেখাইয়া পরিতৃপ্ত থাকি, যোগ্যতা লাভের চেষ্টা করি না; আমরা সব কাজেই পরের প্রত্যাশা করি, অথচ পরের ত্রুটি লইয়া আকাশ বিদীর্ণ করিতে থাকি; পরের অনুকরণে আমাদের গর্ব, পরের অনুগ্রহে আমাদের সমমান, পরের চক্ষে ধুলিনিক্ষেপ করিয়া আমাদের পলিটিকস; এবং নিজের বাক?চাতুর্যে নিজের প্রতি ভক্তিবহুল হইয়া উঠাই আমাদের জীবনের প্রধান উদ্দেশ্য। চারিত্র পূজা। (বিদ্যাসাগর-চরিত, রবীন্দ্রগদ্যের উদ্ধৃতি সংগ্রহ ১৯৪)।

বাঙালির কুসংস্কার নিয়ে, বিজ্ঞান মনস্ক না হওয়া নিয়েও তার অনেক বিশ্লেষণ পাওয়া যায়, রবীন্দনাথ বলেন,” …ভূত-প্রেত বিভিন্ন বিজ্ঞানবহির্ভূত জিনিসের প্রতি আস্থা থাকতে পারে কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে বাঙালির মধ্যে যা, যে সব গুণাবলি পরিলক্ষিত হয়েছে তা তিনি বলেছেন … ‘ভূত-প্রেত, হাঁচি-টিকটিকি, আধ্যাত্মিক জাতিভেদ ও বিজ্ঞানবহির্ভূত অপূর্ব বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা- সবার প্রতি এক প্রকার জীবনহীন জড় বিশ্বাস থাকিতে পারে, কিন্তু মহত্তের প্রতি তাহাদের বিশ্বাস নাই।’ (সাহিত্য। আলস্য ও সাহিত্য রবীন্দ্রগদ্যের উদ্ধৃতি সংগ্রহ ২০১)। রবীন্দ্রনাথ বাঙালি মানসের পরতে পরতে ঘুরে আরও প্রচুর মন্তব্য এবং বক্তব্য রেখে গেছেন, যা জাতি হিসাবে আমাদের সমুখ পানে এগিয়ে যেতে সহায়তা করে। বঙ্গবন্ধু, বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ, নজরুলসহ অসংখ্য মনীষী ছিলেন আমাদের জাতির অভিভাবক, বন্ধু সহযোগী। যুক্তি বুদ্ধি, ভালোবাসায় পরিপূর্ণ ছিল তাদের হৃদয়। তারা জাতির স্বরূপ অন্বেষণ করতে গিয়ে, যে উপায় অবলম্বন করেছেন তা’ ছিল দার্শনিক ও পথপ্রদর্শক সুলভ। (চলবে)

– কথাসাহিত্যিক ঔপন্যাসিক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *