নিঃসঙ্গতা

সোহানুর রেজা: রান্নাঘরের ঠিক পাশেই আরেক বিল্ডিংয়ের বারান্দা। সেখানে একটা বাচ্চা খুব চিৎকার করে। উচ্চশব্দে কথা বলে। প্রায়ই দেখি- বাচ্চাটা একা একাই কথা বলছে। একটা সাইকেল রাখা সেখানে। বাচ্চার বয়স বছর তিন বা সাড়ে তিন হতে পারে। সে সাইকেলের সঙ্গে কথা বলে।

“এই তুই এতো কথা বলিস কেন? তোকে বলেছি চুপচাপ খেয়ে নে। খাবি কি-না বল?’’ এমন অনেক ধমকই দেয় সে সাইকলেটাকে।
মাঝে মাঝে ছেলেটা সাইকেলটাকে বলে- তুই পড়াশোনা করবি না? কী ব্যাপার ঘুমচ্ছিস কেন?

শুরুতে বাচ্চাটার সাইকেলের সঙ্গে এমন কথোপকথনকে স্বাভাবিকভাবেই নিতাম। কিন্তু ইদানীং কেমন যেন লাগে। কাল দেখি সে সাইকেলকে গোসল করিয়ে দিচ্ছে আর প্রশ্ন করছে- “তোমার মন খারাপ বাবু? আসো তোমাকে খাইয়ে দেই। বলেই সে সাইকেলকে ফের ধমক দেয়- কথা বলবে না কিন্তু! কথা বললে মাইর দেব। একদম চুপ, চুপ। কিছু বলি না দেখে না? সাহস বেড়ে গেছে তোমার?’’

খেয়াল করলাম, বাচ্চাটা সারাটাদিন বারান্দায় একা থাকে। মাঝে মাঝে কাজের বুয়া এসে খাইয়ে দেয় তাকে। বাচ্চাটার বাবা-মা দু’জনেই চাকরি করে। সে একা বাসায় থাকে, কার সঙ্গে কথা বলবে? কার সঙ্গেই বা খেলবে? সন্ধ্যার দিকে মা-বাবার দেখা পায় সে। কী এক কঠিন শহর এটা! এতটুকুন বাচ্চা দিনের বেশিভাগ সময় একা। তাই সে মা-বাবার কথোপকথন নিজের মস্তিষ্কে গেঁথে নিয়েছে। তারতো সঙ্গী নেই। কথাগুলো সে আর কাকে বলবে! সঙ্গী হিসেবে সাইকেলকে বেছে নিয়েছে সে।

মাঝে মাঝে এমনও দেখি, সে সাইকলেটার হ্যান্ডেল ধরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। নিচের গলি দেখে। গলিতে খেলা করা অন্য বাচ্চাদের দেখে। হাসে। মন খারাপ করে। আজ সে সকালে সাইকেলটাকে বলছে- সাইকেল বাবু, ও সাইকেল বাবু, চলো আমরা ঘুরতে যাই। আমাকে নিয়ে চলো। এই শহরে আধুনিক একটি পরিবারের নিঃসঙ্গ বাচ্চা সে। যার সঙ্গী একটি জড়বস্তু সাইকেল।

ওদিকে মা-বাবা ব্যস্ত ক্যারিয়ার আর ভবিষ্যতের পেছনে দৌড়াতে। সাইকেল আর কী উত্তর দেবে! সাইকেলের কি আর সে শক্তি আছে? যাদের জবান আছে তারাই তো নেই তার পাশে… বাচ্চাটার সঙ্গে আমরা রান্নাঘর থেকে একটু একটু কথা বলার চেষ্টা করি। বড্ড মায়া লাগে তার জন্য।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *